সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১
Proval Logo

ব্যাংক-আর্থিক খাতের সংস্কার করতে গিয়ে  আমানতকারীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়

প্রকাশিত - ২৪ আগস্ট, ২০২৪   ০৯:১৪ পিএম
webnews24

সম্পাদকীয় 

বলাই বাহুল্য যে, দীর্ঘদিন ধরেই সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের চক্রে আটকে আছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত। ঋণের নামে অর্থ লোপাটের কারণে বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থাই বর্তমানে শোচনীয়; খেলাপি ঋণ আকাশচুম্বী। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। এর দায় বর্তায় মূলত পরিচালনা পর্ষদে থাকা শীর্ষ নির্বাহীদের। এছাড়া এই বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা ও কয়েকজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায় অস্বীকার করার অবকাশ নেই। কিন্তু অভিযুক্ত কাউকে সেভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। বরং ব্যক্তি ও পরিচালনা পর্ষদের অপরাধমূলক কর্মকা-ের ফল ভোগ করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আমানতকারী ও ভালো ঋণগ্রহীতাদের। ওইসব ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকেও চাহিদা অনুযায়ী অর্থ উত্তোলন করা যাচ্ছে না এবং ব্যাংকে জমা পড়া শত শত চেকের নগদায়ন আটকে আছে। বিপদের মুখে পড়েছে এসব ব্যাংকের গ্রাহক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে ভুক্তভোগী গ্রাহক ও ব্যাংকগুলোর এমন দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত যত দ্রুত সম্ভব আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া। পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষার্থে কাজ করা।
ব্যক্তি বা পর্ষদের অপরাধের কারণে গ্রাহক ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সার্বিক অর্থনীতির জন্য আরো সংকট সৃষ্টি করবে। আমানতকারী ও গ্রাহকরা, বিশেষত ভালো ব্যবসায়ী ঋণ গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এর প্রভাবে শ্লথ হয়ে আসতে পারে শিল্প উৎপাদনের গতি। এতে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্থান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি শিল্প খাতে কর্মনিয়োজনও বাধাগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। তাছাড়া দুর্বল হয়ে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। মোটা দাগে বললে, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে আস্থাহীনতার সংকট প্রকট হয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, বর্তমানে একযোগে একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং এর প্রভাবে পুরো অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা করেই ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে গ্রাহক স্বার্থ ও এসব প্রতিষ্ঠান রক্ষার্থে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আমানতের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় একাধিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে এবং একটি নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদে থাকা নিয়ম লঙ্ঘনকারী গ্রুপের শেয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। ব্যাংকের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত সেসব শেয়ার বেচাকেনা করা যাবে না এবং ব্যাংকের মালিকানায় গ্রুপের কেউ থাকতে পারবেন না। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে চেক যেন প্রত্যাখ্যাত না হয় এর জন্য উত্তোলনসীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। এগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তবে স্বল্পমেয়াদি হিসেবে। গ্রাহকস্বার্থ যেন কোনোভাবেই ক্ষুণœ না হয় সেটি বিবেচনায় নিয়ে কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়াও আবশ্যক, যাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তীব্র সংকটগুলো মোচন করা যায়, সংস্কারের মাধ্যমে কাঠামোগত ভিতকে দৃঢ় করা যায়। নয়তো সামষ্টিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না। কেননা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানই যেকোনো দেশের অর্থনীতির হৃৎপি-।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন না থাকলে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি দেশের অর্থনীতিতে ধস নামাতে পারে। এদিকে দেশে এই খাত নানা সংকটে মুহ্যমানÑ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, আমানত ঘাটতি, মানুষের আস্থাহীনতা। রয়েছে ব্যাংকগুলোয় আয়-ব্যয়ের আকাশচুম্বী পার্থক্যও। এসব দেশের ব্যাংক খাতগুলোর অনিয়ম ও সুশাসনহীনতারই প্রতিচ্ছবি। তাই অনতিবিলম্বে এ খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। ব্যাংক ব্যবস্থা যত সুশৃঙ্খল, যত বেশি নিয়ম-কানুন মেনে চলে, তত বেশি ভালোভাবে চলতে পারে। এতে যেমন ব্যাংকের ভালো হয় তেমনি দেশেরও ভালো হয়। সরকারি ও বেসরকারি খাতের উন্নয়নে স্বচ্ছ ও ভালো স্বাস্থ্যের ব্যাংক খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার সক্ষমতা ও ঋণের ঝুঁকি কম বিবেচনায় নেয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের অনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় ক্ষতÑ এই কথা সর্বজনবিদিত। তবু বছরের পর বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কিংবা নিয়ন্ত্রণে দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো শক্ত পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। বরং বরাবরই কৌশলে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। পুনঃতফসিলের নামে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে প্রভাবশালীদের। এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।
গত ১৮ আগস্ট ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও গভর্নরের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ব্যাংক খাতে টেকসই সংস্কার করার জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন ও দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করার। এছাড়া আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি ও সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে; যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা অনেক আগে থেকেই ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য এমন একটি কমিশন গঠনের কথা বলে আসছিলেন। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত পুনরুদ্ধারে এই কমিশন গঠন একটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে এ কমিশনের উদ্দেশ্য ও কার্যপরিধির ওপর নির্ভর করবে এটি কতটা কার্যকর ও সফল হবে। এক্ষেত্রে কমিশনে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক বা দলীয়করণের প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে কাজ করার স্বাধীনতা প্রদান করবে বলেই সবার প্রত্যাশা। 

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন