সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১
Proval Logo
দেশের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে

ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসিদের উদ্ধার চিকিৎসা  ত্রাণসহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে

প্রকাশিত - ২৬ আগস্ট, ২০২৪   ০৮:৫৪ পিএম
webnews24

 

 

সম্পাদকীয়

দেশে চলমান বন্যায় ১১ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৩ জনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বন্যায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪ জন। গতকাল সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সব নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সোমবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি। উজানে নদ-নদীর পানি কমার ধারা অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে ফেনী ও কুমিল্লা জেলার নি¤œাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। বলাই বাহুল্য যে, উজানের পাহাড়ি ঢল, স্থানীয় মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও বঙ্গোপসাগরে নি¤œচাপের কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় আকস্মিক বন্যায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। মানুষের ঘরবাড়ি, খেতখামার, পুকুর, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। অনেকেই পানিবন্দি হয়েছেন। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আবার পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে এসব জেলার মানুষের জনদুর্ভোগ সহজেই অনুমেয়। এখন দরকার বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষের কাছে ত্রাণ ও চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো। লক্ষ করা যাচ্ছে, দক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাবে তা ব্যাহত হচ্ছে। তাই বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার, চিকিৎসা ও ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমের উদ্যোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই নিতে হবে। 
ত্রাণসামগ্রী নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ বন্যা উপদ্রুত এলাকায় যাচ্ছে। কিন্তু তারা রাস্তাঘাট চেনে না। শহর ও গ্রাম পানির নিচে ডুবে থাকার কারণে বুঝতে পারছে না কোন দিকে যেতে হবে। ফলে তারা রাস্তার আশপাশের জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারছে না। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবী এক দলের সঙ্গে অন্য দলের সমন্বয় না থাকায় ঘুরেফিরে একই জায়গায় ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে। সমন্বয়হীনতার কারণে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেনি। এখন দরকার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে অবিলম্বে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো যায়। পানিবন্দি মানুষকে দ্রুত উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করা। যদিও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী হেলিকপ্টারে করে বন্যার্তদের উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর মেডিকেল টিম মোতায়েন রয়েছে। বন্যার্তদের সহযোগিতায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জরুরি ত্রাণ সংগ্রহের কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে দেশব্যাপী। বন্যার্তদের ত্রাণ সহযোগিতায় সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার, ওষুধসহ বিভিন্ন মৌলিক জিনিসপত্রের তীব্র সংকট। মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখতে হবে। 
গত মঙ্গলবার থেকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ফেনী ও কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ১১টি জেলায় ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ লাখ ৯ হাজার ৭৯৮। এখন পর্যন্ত বন্যায় ১৮ জনের মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নিখোঁজ আছেন দুজন। জেলাগুলোয় ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে ৪ লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যারা আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে বাড়িতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত। এ মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হলো ত্রাণ ও ওষুধ সরবরাহ এবং বন্যাকবলিত এলাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করা। বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, চিকিৎসা দল এবং অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করলে বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষ সুফল পাবে। 
আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় যাতে রোগ ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজর দিতে হবে। দুর্গত এলাকায় খাদ্য ও ওষুধ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বাগ্রে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রশাসনকেও। দেশে বহু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আছে, তাদেরও এ ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সরকারিভাবে অনেক এলাকায় ত্রাণসহায়তা দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এসব মানুষের কাছে অতিদ্রুত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র এবং নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। গৃহপালিত পশুপাখি নিরাপদে সরিয়ে আনতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও দেশের সামর্থ্যবানদের বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।
এরপর বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলে প্রত্যেকের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। বিশেষ করে যাদের ঘরবাড়ি ও কৃষি, মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ঘর মেরামত করতে হবে তাকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। যার কৃষি উপকরণ দরকার তাকে উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে তা মেরামত ও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা প্রয়োজন। মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো আমাদের আয়ত্তের বাইরে। তবে যথাযথ প্রস্তুতি নিলে মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বন্যার্তদের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ত্রাণসহায়তা আসছে সেগুলো তাদের কাছে সুন্দরভাবে পৌঁছাতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ও প্রশাসন এই বিষয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে বলেই প্রত্যাশা সবার।
 

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন