প্রভাত অর্থনীতি: পারস্য উপসাগর থেকে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশের একমাত্র সমুদ্রপথ হলো হরমুজ প্রণালী। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথ বন্ধ হলে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যেতে পারে। মার্কিন বিমান হামলায় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার পরিপ্রেক্ষিতে হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। রবিবার (২২ জুন) দেশটির পার্লামেন্ট এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম প্রেস টিভি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা-নীতি নির্ধারণী সংস্থা সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এসএনএসসি)।
প্রস্তাবটি প্রতীকী হলেও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য গভীর। তেহরানের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হামলাকে ‘খোলাখুলি আগ্রাসন’ হিসেবে বর্ণনা করার পর দেশটির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর পাল্টা জবাব দেওয়ার চাপ বাড়তে থাকে।
ইরানি সংসদ মজলিশের সদস্যদের বরাতে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ‘প্রণালী বন্ধে অনুমোদন দিতে সংসদ সদস্যরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভোট দিয়েছেন।’ এখন বিষয়টি এসএনএসসির পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। সংস্থাটি জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথ বন্ধ হলে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যেতে পারে এবং সেই সাথে ইরান-ইসরায়েলের সংঘাত আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পারস্য উপসাগর থেকে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশের একমাত্র সমুদ্রপথ হলো হরমুজ প্রণালী। এর এক পাশে অবস্থিত আরব দেশগুলো, যাদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্রসমূহ, এবং অন্য পাশে রয়েছে ইরান।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় তেল রপ্তানি করা হয় হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল যায় এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্যান্য জায়গায়।
মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের মতে, বিশ্বে প্রতিদিন ব্যবহৃত মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালী দিয়ে পরিবহন করা হয়। সংস্থাটি একে বিশ্বের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেলবাহী চোকপয়েন্ট’ হিসেবেও উল্লেখ করেছে।
প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশ মাত্র ৩৩ কিলোমিটার প্রশস্ত হলেও এর ভেতরের নৌচলাচল পথ আরও সংকীর্ণ—ফলে এটি হামলা বা অবরোধের হুমকির জন্য সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে উভয় দেশ উপসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছিল। ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত সেই সময়েও হরমুজ প্রণালী পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনার সময় হরমুজের কাছে ফুজাইরাহ উপকূলে চারটি জাহাজে হামলা হয়। ওই ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে দায়ী করলেও তেহরান তা অস্বীকার করে।
সংঘাতের সময় গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে হামলা চালিয়ে চাপ সৃষ্টি করার কৌশল নতুন নয়। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও আরব উপদ্বীপের বিপরীত পাশে বাব আল-মানদেব প্রণালীতে একাধিক জাহাজে হামলা চালিয়েছে।
হুথিদের এসব হামলায় লোহিত সাগর দিয়ে নৌযান চলাচল বাধাগ্রস্ত হলেও বিকল্প হিসেবে আফ্রিকার চারপাশ ঘুরে দীর্ঘ পথে যাতায়াত সম্ভব। কিন্তু পারস্য উপসাগর থেকে হরমুজ প্রণালী ছাড়া কোনও জাহাজের সমুদ্র পাড়ি দেয়ার পথ নেই।
ফলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে শুধু উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল আমদানিকারক দেশগুলো নয়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব দেশই অর্থনৈতিক চাপে পড়বে। এছাড়া, হরমুজ প্রণালী হচ্ছে ইরানের জ্বালানী তেল রপ্তানির প্রধান রুট। ইরানের অর্থনীতির জন্য এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
ইরানের মোট রপ্তানি আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ আসে জ্বালানী তেল রপ্তানির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ইরান ৬৬০০ কোটি ডলারের তেল রপ্তানি করেছে। তবে ইরানি সংসদ সদস্যের হুমকি সত্ত্বেও এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে তেহরান আদৌ প্রণালীটি বন্ধ করার মতো সামর্থ্য কিংবা রাজনৈতিক সদিচ্ছা রাখে কি না।
এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য নৌ-সামরিক উপস্থিতির কারণে, হরমুজ প্রণালী বন্ধের মতো পদক্ষেপের জবাবে সেখান থেকে প্রতিক্রিয়া আসা প্রায় নিশ্চিত।
পাশাপাশি, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে এতে যুক্তরাষ্ট্র-ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর জবাবে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত শুক্রবার ভোরে ইসরায়েল ইরানের সামরিক নেতাদের বাসভবন, সেনাঘাঁটি ও পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালায়। এর পাল্টা জবাবে ইরান শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সহায়তা করলেও সরাসরি ইরানকে লক্ষ্য করে কোনো হামলা চালায়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে জানান, ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তেহরানও এখন পর্যন্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়নি। যদিও ইরান এখনই হরমুজ প্রণালী বন্ধের সুনির্দিষ্ট হুমকি দেয়নি, তবে ইরানি সংসদ সদস্য এসমাইল কোসারির সাম্প্রতিক মন্তব্যে ইঙ্গিত মিলেছে—সংঘাত চলাকালে এই গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে হামলার বিষয়টি তেহরান সম্ভাব্য কৌশল হিসেবে বিবেচনা করছে। এর আগে, ২০২৪ সালের এপ্রিলেও ইরানি বাহিনী হরমুজ প্রণালীর কাছে একটি কনটেইনার জাহাজ জব্দ করে। তার কিছুদিন আগে, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় একাধিক কর্মকর্তা নিহত হন। এর জবাবে ইরান সীমিত পাল্টা হামলা চালায়, এবং ইসরায়েলও পাল্টা জবাব দেয়। ওই সময়ই ছিল দু’পক্ষের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ।
এদিকে ইরান যাতে হরমুজ প্রণালী বন্ধ না করে তার জন্য বোঝাতে চীনকে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রবিবার (২২ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এ আহ্বান জানান। এ আহ্বান জানানোর পরই ওয়াশিংটন ইরানের আরেকটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। রুবিওর এই মন্তব্য ফক্স নিউজের “সানডে মর্নিং ফিউচারস উইথ মারিয়া বার্তিরোমো”-এর একটি অনুষ্ঠানে দেখানো হয়। এরপর ইরানের প্রেস টিভি পরবর্তীতে একটি প্রতিবেদনে জানায়, ইরানের সংসদ হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল ও গ্যাস পরিবহণ করা হয়।
রুবিও বলেছেন, ‘আমি বেইজিংয়ে চীনা সরকারকে এটি নিয়ে ইরানের সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহিত করছি, কারণ তারা তাদের তেলের জন্য হরমুজ প্রণালীর উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি তারা এটি করে, এটি হবে আরেকটি ভয়ঙ্কর ভুল। এটি তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যা হবে। এবং আমাদের কাছে তা মোকাবেলা করার বিকল্প থাকবে, তবে অন্যান্য দেশগুলোকেও এটি নজরে রাখতে হবে। এটি আমাদের চেয়ে অন্যান্য দেশের অর্থনীতির উপর অনেক বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।’
রুবিও বলেছেন যে, প্রণালী বন্ধ করার পদক্ষেপ ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করবে এবং এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই প্রতিক্রিয়া জানাবে।
ওয়াশিংটনের এমন আহ্বানে চীনের দূতাবাস তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন যে তারা ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো “ধ্বংস” করেছে। তারা ১৪টি বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমা, দুই ডজনেরও বেশি টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১২৫টিরও বেশি সামরিক বিমান ব্যবহার করেছে। এই হামলাগুলো মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে এক নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে।
তেহরান তাদের প্রতিরক্ষা করার শপথ নিয়েছে। রোববার রুবিও পাল্টা হামলা করার বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, এমন একটি পদক্ষেপ হবে “তাদের (ইরান) করা সবচেয়ে বড় ভুল। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত।