প্রভাত রিপোর্ট: দেশের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ দৈনন্দিন জীবনে অন্তত একবার পাউরুটি কিংবা বিস্কুট খাচ্ছেন। সময়ের অভাব ও ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলাতে গিয়ে সকালের খাবার বাদ দিচ্ছেন অনেকে। এক জরিপে দেখা গেছে, যাদের মাসিক আয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে, তাদের ৬০ শতাংশই সকালের নাশতা বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে দ্রুত পেট ভরাতে তারা পাউরুটি, কলা কিংবা বিস্কুটের মতো সহজপ্রাপ্য খাবার বেছে নিচ্ছেন।
এই তথ্য উঠে এসেছে ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্ক পরিচালিত এক জরিপে। চলতি বছরের মার্চে দেশের ১৫টি এলাকা থেকে ১ হাজার ২২ জনের ওপর জরিপটি চালানো হয়। এতে দেখা যায়, ৯৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী কোনো না কোনো সময় ভারী খাবার বাদ দিয়ে হালকা খাবারে দিন পার করছেন। বিশেষ করে দুপুর ও বিকেলের খাবার তারা নিয়মিতভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও ভ্যাট’ শীর্ষক সেমিনারে এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা, সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম, প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক পার্থ শঙ্কর সাহা এবং বিস্কুট ও ব্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া।
মূল প্রবন্ধে ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্কের গবেষণাপ্রধান ইমরুল হাসান বলেন, মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। এর সঙ্গে রয়েছে বেকারত্ব ও আয় বৈষম্য। এমন বাস্তবতায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিস্কুট ও পাউরুটির ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে উঠেছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যাশা করেছিলেন, বাজেটে এমন পণ্যে কর ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
সেমিনারে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, পাউরুটি ও বিস্কুটের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট আরোপ নিয়ে সবসময় বিতর্ক থাকবে। এটি একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারকে অনেক দিক বিবেচনায় রাখতে হয়। তিনি জানান, দেশের বাজেট ইতিহাসে এই প্রথমবার বাজেটের আকার কমেছে, যাতে করে জনগণের ওপর আর্থিক চাপ কম পড়ে এবং রাষ্ট্র ঋণের বোঝাও হ্রাস পায়।
তিনি আরও বলেন, করনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শর্ত পূরণের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। কারণ ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠছে। এই পরিবর্তনের আগে শুল্কহার ধাপে ধাপে কমানো জরুরি। বর্তমানে দেশের কিছু পণ্যে সর্বোচ্চ ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রয়েছে, যা টিকিয়ে রাখা ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
ভ্যাট আরোপের বাস্তবায়ন নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘যেসব পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, সেখানে ব্যবসায়ীরা যদি নিজেরা এই ভ্যাট না বহন করে তা পুরোপুরি ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেন, তাহলে সেটি সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করতে পারে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও জানান, চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সংখ্যা ১৭ লাখ ছাড়িয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি। জুলাই থেকেই রিটার্ন জমা দেওয়ার সুযোগ থাকছে, এবং ‘ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো’ চালুর মাধ্যমে ১৯টি সংস্থার ১১০ ধরনের লাইসেন্স, অনুমোদন ও সনদ অনলাইনে পাওয়া যাবে।
তিনি এনবিআর কর্মীদের চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন, এই আন্দোলনের ফলে রাজস্ব সংগ্রহে কিছুটা বাধা তৈরি হয়েছে। তবে সকলকেই দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং যেকোনো সংস্কার বা আন্দোলন যেন দেশকেন্দ্রিক হয়, ব্যক্তিগত নয়।
সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে ভ্যাট থাকা উচিত নয়। যদি ভ্যাট আরোপ করতেই হয়, তাহলে তা সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হওয়া উচিত। আমি এবারের বাজেটে সেই সুপারিশও করেছিলাম, যার সঙ্গে এফবিসিসিআইও একমত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।’
সেমিনারের আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন, খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুষ্ঠু ও সমন্বিত করনীতির মাধ্যমে এমন জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ কমানো জরুরি।