প্রভাত রিপোর্ট: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান তথা গত বছরের ৫ আগস্ট থেকেই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লম্ফন শুরু হয়। প্রবাসী বাংলাদেশীরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় গত কয়েক মাসে বৈধ পথে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এ কারণে আগের তুলনায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। জুনের প্রথম ২৮ দিনে প্রবাসীরা ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। গত বছরের জুনের একই সময়ে ২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। ২৮ জুন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের আগে দেশে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগের ওই বছরে প্রবাসীরা ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আসে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বেড়ে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
দেশে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসার রেকর্ড হয়েছে। ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া চলতি অর্থবছরে ৩ হাজার কোটি বা ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষ হওয়ার দুইদিন আগেই প্রবাসীরা দেশকে এ নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২৮ জুন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে ৩০ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে প্রবাসীরা ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বেশি পাঠিয়েছেন।
এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ও উন্নয়ন সহযোগীদের দেয়া ঋণে ভর করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) গতকাল দেশে রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গতকাল গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে নিট রিজার্ভ ২০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার ছিল বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল, সেটি এখনো অব্যাহত রয়েছে। প্রবাসীরা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে এক অর্থবছরে আমরা ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় সুসংবাদ। আগামীতেও রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার বিষয়ে আমরা আশাবাদী।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, এআইআইবি, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী তাদের প্রতিশ্রুত ঋণ ছাড় দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণসহায়তা যুক্ত হওয়ায় রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আশা করছি, রিজার্ভের এ বৃদ্ধিও অব্যাহত থাকবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, চলতি মাসে আইএমএফ থেকে ১৩৫ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৯০ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংক থেকে ৫০ কোটি ডলার, জাইকা থেকে ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং এআইআইবি থেকে ৪০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে গত এক সপ্তাহে ৩৫৬ কোটি ডলারের বেশি ঋণসহায়তা দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। রেকর্ড রেমিট্যান্স আর এ ঋণের ওপর ভর করে দেশের রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
দেশ থেকে টাকা পাচারের পথ সংকুচিত হয়ে আসায় দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিদেশে হুন্ডির চাহিদা তৈরি হয় দেশ থেকে। বাংলাদেশীদের পাচারকৃত অর্থের বড় অংশ বিদেশে প্রধান শ্রমবাজারগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ থেকে টাকা পাচারের পথ অনেকটাই সংকুচিত হয়ে এসেছে। এ কারণে বিদেশে হুন্ডি কারবারিদের চাহিদাও কমে গেছে। কালোবাজারে চাহিদা কমলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে রেমিট্যান্স প্রবাহে যে উল্লম্ফন আমরা দেখছি, সেটি তারই প্রভাব।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, রেমিট্যান্সের বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর হতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ হলে হুন্ডির তৎপরতাও কমে যাবে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আরো বেশি উৎসাহিত হবেন। আর যে প্রবাসীরা অর্থনীতিতে এত বড় ভূমিকা রাখছেন, তাদের জন্যও সরকারের দিক থেকে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
ডলার সংকটের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশে রিজার্ভের ক্ষয় শুরু হয়। ওই বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া রিজার্ভ দুই বছরের মধ্যে অর্ধেকে নেমে আসে। অল্প সময়ের ব্যবধানে টাকার প্রায় ৪৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটে। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ১২৩ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।