• রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৭ পূর্বাহ্ন

বলিউডে জনসংযোগের বিষয়টি গুটিকয় ব্যক্তির হাতে আবদ্ধ

প্রভাত রিপোর্ট / ৮ বার
আপডেট : শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

প্রভাত বিনোদন: প্রচার-প্রচারণার কাজে তারকারা কোথাও গেলে সেখানে ফটোগ্রাফার পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয় বিনোদন বিটের সাংবাদিকদের কাছে। এসব বার্তা পাঠানো হয় ‘এ’ গ্রেডের তারকা থেকে শুরু করে উঠতি ইনফ্লুয়েন্সারদের জন্য। খুদে বার্তায় সময়ও উল্লেখ থাকে। শুধু তা-ই নয়, কোনো অভিনয়শিল্পী কিংবা নির্মাতা যখন বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তাঁদের সেই বিষয়গুলো সামনে না আনার জন্যও বার্তা পাঠানো হয়।
কারা এসব কাজ করেন? একজন নিয়োগ পাওয়া পাবলিক রিলেশন অফিসার বা জনসংযোগ কর্মকর্তা। তারকাদের ফুটফরমাশের দিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি তাঁদের মতিগতি বুঝে বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণ করে চলাই জনসংযোগ কর্মকর্তার কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটির পক্ষে যাঁরা জনসংযোগের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যা কথা রটাতে থাকেন। একপর্যায়ে ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁকে কালোতালিকাভুক্ত করা হয়। ফলে তিনি তারকা কিংবা তারকার পক্ষের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন না। এমনকি সিনেমা মুক্তির আগের দিন যে বিশেষ প্রদর্শনী হয়, সেখানেও তিনি আমন্ত্রণ পেতেন না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস যেসব সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁদের সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে বলিউডে জনসংযোগের বিষয়টি গুটিকয় ব্যক্তির হাতে আবদ্ধ। তাঁরা তারকাদের নেতিবাচক দিকগুলোর পরিবর্তে ইতিবাচক বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার জন্য চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। আবার কোনো তারকার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় কেউ যেন বিতর্ক উসকে দেওয়ার মতো কোনো প্রশ্ন না করেন, সে বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। যদি কোনো সাংবাদিক এমনটা করে থাকেন, তাহলে তাঁর জন্য বিপজ্জনক সব পরিস্থিতি অপেক্ষা করে। একজন চলচ্চিত্র সমালোচক জানান, ভারতের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর একটিতে প্রচারিত একটি সিরিজের সমালোচনা করেছিলেন তিনি। সমালোচনার শেষের কয়েকটি লাইন প্ল্যাটফর্মটির পছন্দ হয়নি। তাই তা পরিবর্তন করতে বলা হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি তা করেননি। পরিণতি হিসেবে জনসংযোগের কুৎসিত চেহারার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটির পক্ষে যাঁরা জনসংযোগের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যা কথা রটাতে থাকেন। একপর্যায়ে ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁকে কালোতালিকাভুক্ত করা হয়। ফলে তিনি তারকা কিংবা তারকার পক্ষের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন না। এমনকি সিনেমা মুক্তির আগের দিন যে বিশেষ প্রদর্শনী হয়, সেখানেও তিনি আমন্ত্রণ পেতেন না।
ওই সমালোচকের বিরুদ্ধে প্ল্যাটফর্মটি অভিযোগ তোলে, তাদের সমালোচনার যে বিধিনিষেধ আছে, তিনি নাকি তা ভঙ্গ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মোটেও তেমনটা করিনি। তাদের সিরিজের অংশবিশেষ আগেই প্রকাশ করে আমার কী লাভ! আমার এক বন্ধু প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ টিমে যোগ দেওয়ার পর আমাকে জানায় যে আমার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ টিম প্রচুর মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে। এমনকি প্ল্যাটফর্মটির আন্তর্জাতিক জনসংযোগ টিমকে জানানো হয় যে আমি একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির বিধিনিষেধ ভঙ্গ করেছি।’ যদিও প্ল্যাটফর্মটি তাঁর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়।
ধীরে ধীরে ওই সমালোচক তাঁর অবস্থান ফিরে পেতে শুরু করলেও সব অনুষ্ঠানে তাঁকে খুব একটা ডাকা হতো না। তাঁর বন্ধু যেসব অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকতেন, সেগুলোতে বেশি ডাকা হতো। তাঁর অভিযোগ, ‘কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। শুধু যেসব সমালোচক ইতিবাচকভাবে রিভিউ দেবেন বলে তাঁদের কাছে মনে হতো, শুধু তাঁদেরই ডাকা হতো। বাকিদের এড়িয়ে চলা হতো।’
টেলিভিশন, প্রিন্ট ও ডিজিটাল মাধ্যমে অভিজ্ঞ একজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক মনে করেন, তিন দশক আগেও ইন্ডাস্ট্রিকে এমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো না। তিনি যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন, তখন শুধু দুটি টেলিভিশন চ্যানেল ও কয়েকটি পত্রিকা ছিল। তাই সাংবাদিকতা করাটা বেশ সহজ ছিল। এখন যেটাকে জনসংযোগ বলা হয়, তখন সেটা ছিল না। ২০০০ সাল থেকে জনসংযোগের নামে ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়েছে বলেন উল্লেখ করেন তিনি, ‘যখন সাংবাদিকেরা তারকাদের পরিচালনা করতে শুরু করলেন, তখনই জনসংযোগ নামের খেলা শুরু হয়ে গেল। ঘটনা এর পর থেকে অতিমারি আকার ধারণ করতে শুরু করে।’
জ্যেষ্ঠ ওই সম্পাদক জানান, সাংবাদিক আর প্রচারকদের মধ্যে সব সময়ই ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর ব্যাপারটা ছিল। প্রশ্ন করতে পারেন, কেমন সেটা? তা হলো, প্রচারণার সুবিধার্থে বড় সব তারকা একসময় সংবাদমাধ্যমগুলোর অফিসেও যেতেন। কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাঁরা সেখানে অপেক্ষা করতেন। এখন সেই সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বেশ অনীহা লক্ষ করা যায়।
২০১২ সালে একজন তরুণ অভিনেতা তাঁর স্বাধীনধারার সিনেমা মুক্তির আগে নিজে থেকেই সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন ওই সম্পাদককে। ওই অভিনেতাকে তাঁর প্রজন্মের সেরাদের একজন মনে করা হয়। সম্প্রতি সর্বকালের সবচেয়ে বড় হিন্দি ভাষার হিট ছবিতে অভিনয় করেছেন ওই অভিনেতা। সম্পাদক বলেন, ‘বর্তমানে এখন আর ওই অভিনেতার সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে জনসংযোগের হ্যাপা পোহাতে হবে।’
তিন খানকে নিয়েই সিনেমা নির্মাণ করা একজন পরিচালক একবার সাংবাদিকদের একটি দলকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা বলে পাক্কা আট ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়ে যখন সাংবাদিকেরা ভেন্যুতে গিয়ে পৌঁছান, তখন পিআর এজেন্সি থেকে জানানো হয় যে পরিচালক হাজার মাইল দূরে কাশ্মীরে অবস্থান করছেন। দেশের সেরা সংবাদমাধ্যমগুলোর ৩০ সাংবাদিক ও ভিডিওগ্রাফারকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য ন্যূনতম দুঃখ প্রকাশ তো তিনি করেনইনি, পিআর এজেন্সির অব্যবস্থাপনা নিয়েও কোনো অবস্থান তাঁকে নিতে দেখা যায়নি।
তারকা–সন্তানদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পরিচিতি পাওয়া একটি পিআর এজেন্সি কয়েক বছর আগে থেকে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। একজন প্রবীণ শিল্পপতির পরামর্শে পরিচালিত এজেন্সিটি ‘মাত্র তিনজন সাংবাদিককে’ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ দিত বলে অভিযোগ রয়েছে। জ্যেষ্ঠ ওই সম্পাদক জানান, আজকাল তো সাক্ষাৎকারের বিষয়টি স্বয়ং তারকাদেরও ঠিকমতো জানানো হয় না।
ওই সম্পাদক একজন প্রবীণ অভিনেতার প্রশংসা করেন, যিনি তাঁর তারুণ্যের গুণের জন্য প্রশংসিত। তো, সেই অভিনেতা একদিন তাঁর সিনেমার প্রচারণার জন্য বেশ প্রভাবশালী এক রিল নির্মাতার আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেন। অভিনেতা বলেন, অনেক তরুণ তারকা তাঁদের সিনেমার প্রচারণার স্বার্থে এমন সব কৌশলের প্রতি আগ্রহ দেখান। সম্পাদক বলেন, ‘কিছু পিআর এজেন্সি তারকাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দেয়। এতে করে সাক্ষাৎকারগ্রহীতা আহ্লাদে গদগদ হয়ে যান। তাঁরা তারকাদের সঙ্গে নিজেদের কিছু ছবি তোলেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। এটাই প্রচারের কৌশল হয়ে উঠেছে।’ খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বলিউডের বড় বাজেটের একটি সিনেমার শুটিংয়ে এর অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে একদল সাংবাদিক (যাঁরা তারকাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা পোস্ট করেন) আটকা পড়েন। অপর এক সাংবাদিক এ ঘটনার একটি ভিডিও মজা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। পোস্টে তিনি ‘এ’ গ্রেডের একজন তারকার প্রতি আটকে পড়া সাংবাদিকদের উদ্ধার করার অনুরোধ রাখেন, যিনি বলিউডে ‘ত্রাণকর্তা হিসেবে বেশ পরিচিত। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওই সাংবাদিকের কাছে কল আসতে শুরু করে। তাঁকে ওই ভিডিও মুছে ফেলতে বলা হয়।
ভারতের শীর্ষ একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কর্মরত একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর কাজের ব্যাপারে বেশ খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মিডিয়ার কড়া নজরদারির মধ্যেও ‘হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্ট’দের ভাবমূর্তি জনসমক্ষে তুলে ধরা, স্ক্যান্ডাল বা গুজবের মতো সংকট মোকাবিলা, সাংবাদিকদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখা, নেতিবাচক প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ করা এবং সফল প্রচার নিশ্চিত করা—এসবই তাঁদের কাজ। শুধু তা-ই নয়, যেসব তারকা বা পরিচালক নিজেদের সেরা অবস্থানে নেই, তাঁদের প্রমোশনাল ক্যাম্পেইনের মতো কষ্টসাধ্য কাজও তাঁদের করতে হয়। আবার তারকাদের ‘পর্দার আড়ালের রেষারেষি’ আড়ালে রেখেই ইতিবাচক প্রচারণার দায়িত্ব তাঁদের সামলাতে হয়।
এমনটা করতে গিয়ে ‘ব্যক্তিগত মূল্যবোধের’ সঙ্গে আপস করতে হয় বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই কঠিন। নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে না মিললেও কোনো কোনো প্রচারণা চালিয়ে যেতে হয়। ধীরে ধীরে শরমের মাথা খেতে শিখে গেছি। নিজেকে শুধু বোঝাতে থাকি, দিন শেষে এটা আমার কাজ। সব পেশাতেই কোনো না কোনোভাবে আপস বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।’
জ্যেষ্ঠ ওই সম্পাদক বলেন, ‘জনসমক্ষে কোনো ঝামেলার মুখোমুখি যাতে না হতে হয়, সে ব্যাপারে তারকারা “খুব সতর্ক” হয়ে গেছেন। তাঁরা আগে থেকেই কথা বলার বিষয়বস্তু আর প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। এ জন্য কারও কারও সঙ্গে আমার ঝগড়া পর্যন্ত হয়েছে। আমি তখন জানিয়েছি, তাঁদের সঙ্গে কথা বলার আমার দরকার নেই।’
বলিউডে আরেকটি সাধারণ ঘটনা হচ্ছে তারকাদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিতে গেলে ফুটেজ চেক করা। যদি কোথাও কোনো অসংগতি মনে হয়, তাহলে ওই অংশ ফুটেজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। কখনো কখনো তা আর ফেরত দেওয়াই হয় না। এভাবে সাংবাদিকদের একধরনের জিম্মি করে রাখা হয়।
আরেক সমালোচক ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাঁর করা রিভিউ নিয়ে বিভিন্ন সময় আসা চাপের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘তিনটি বড় প্ল্যাটফর্ম থেকে ফোন করে রিভিউ কেন নেতিবাচক সুরে লেখা হয়েছে কিংবা কেন একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হতো। আমার ক্যারিয়ারের প্রথম দুই বছরে তারা বেশি চাপ দিত। তারা আমাকে রিভিউয়ের নেতিবাচক শিরোনাম করা থেকে বিরত থাকতে বলত। আমার কথা হলো, তারা আমার শিরোনাম নির্ধারণ করে দিতে পারে না।’
সম্মুখসারির একটি গণমাধ্যমে কর্মরত একজন প্রতিবেদক বলেন, ‘কিছু সাংবাদিককে চিহ্নিত করা হয় এবং সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের অংশ নিতে দেওয়া হয় না। ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ ইভেন্ট কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানোর আগে যাচাই করে নেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে ভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন, এমন সাংবাদিকদের হাতে মাইক্রোফোন দেওয়া হয় না। কিছুদিন আগেও এমন আচরণ দৃষ্টিকটু মনে করা হতো। এখন এটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে।’


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও