প্রভাত স্পোর্টস: জাতীয় দলের পরবর্তী ম্যাচ আগামী অক্টোবরে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচ, প্রতিপক্ষ হংকং। একটি ম্যাচ ঢাকায়, অন্যটি হংকংয়ে। তার আগপর্যন্ত জাতীয় দলের কোনো ক্যাম্প নেই। আপাতত বিদায় বেলায় হামজা-শমিত বলে গেলেন, ‘দেখা হবে অক্টোবরে।’ সেই কথায় ছিল একধরনের অপেক্ষা। আবার দেখা হবে, আবার বাংলাদেশের জার্সি পরা হবে, আবার তাঁরা লড়াইয়ে নামবেন দেশের জন্য।
ভুটান ও সিঙ্গাপুর ম্যাচের জন্য প্রস্তুতির ক্যাম্প শেষ। হোটেলের ঘরগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। খেলোয়াড়েরা ফিরে গেছেন যে যাঁর আপন ঠিকানায়। আপাতত কোনো ঘরোয়া প্রতিযোগিতা নেই। শুধু নতুন মৌসুমের জন্য শুরু হয়ে গেছে খেলোয়াড় নিবন্ধনের প্রক্রিয়া। জাতীয় স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইটের আলো তখন নিভে গেছে। খালি গ্যালারি, প্রায় শূন্য প্রেসবক্স। স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে ২-১ গোলে পরাজয়ের আক্ষেপ। সেই পরাজয়ের ভার নিয়েই রাত ১০টার দিকে বাংলাদেশ দল ফিরে যায় শাহবাগের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। সিঙ্গাপুর ম্যাচ ঘিরে যতটা উন্মাদনা, শেষবেলায় ততটাই হতাশা। ম্যাচটা যদি অন্তত ড্র হতো, কিছুটা সান্ত্বনা মিলত, কিন্তু তা-ও হলো না।
হোটেলেও যেন ছিল স্টেডিয়ামের নিঃশব্দতা। পরিবেশটা যেন এক ভাঙা হাঁট। কেউ কথা বলছেন না, কেউ চুপচাপ ফোনে তাকিয়ে, কেউবা লাগেজ টেনে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। একটা লড়াইয়ের শেষ, এখন তো স্যুটকেস গুটিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। রাত ১১টায় বাংলাদেশ দলের হোটেলে ঢুকে প্রথমেই দেখা ডিফেন্ডার ঈসা ফয়সালের সঙ্গে। ভুটান ও সিঙ্গাপুর—কোনো ম্যাচেই মাঠে নামা হয়নি তাঁর। অনেকেই ভেবেছিলেন সিঙ্গাপুর ম্যাচে রাইট ব্যাক তাজ উদ্দিনের বদলে দেখা যাবে ঈসাকে। কোচ হাভিয়ের কাবরেরা আস্থা রেখেছেন শাকিল তপুর ওপর। হোটেল ছাড়ার মুখে ঈসার মুখে বিষাদের ছায়া, বললেন, ‘হারের পর আসলে কিছু বলার থাকে না। প্রথমার্ধটা আমাদের অত ভালো হয়নি, তবে দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম।’ এরপর একে একে লবিতে নামলেন ইব্রাহিম, সুমন রেজা, ফাহিম। সবাই লাগেজ হাতে। বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে সবাইকে হোটেল ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আগেই।
এক ফাঁকে দেখা গেল বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল, সহসভাপতি ফাহাদ করিমসহ কর্মকর্তাদেরও হোটেল ত্যাগ করতে। তাঁরা ফুটবলারদের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। এই হারে ভেঙে পড়ার কিছু নেই, এমনটাই সভাপতি বলেছেন ফুটবলারদের। হামজা চৌধুরী ও শমিত সোম আজ সকাল পৌনে সাতটায় ঢাকা ছেড়েছেন। টার্কিশ এয়ারলাইনসের একই ফ্লাইটে উঠেছেন দুজন। হামজার গন্তব্য ইংল্যান্ড, শমিতের কানাডা। সিঙ্গাপুর ম্যাচে অভিষিক্ত শমিত দারুণ খেলেছেন। দল হারলেও নিজেকে মেলে ধরার তৃপ্তি নিয়ে ভোর চারটার দিকে হামজার সঙ্গে হোটেল ত্যাগ করেন তিনি। হামজার বাবা-মাও আজ ঢাকা ছাড়বেন অন্য একটি ফ্লাইটে।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে হোটেলের লবিতে দেখা গেল টিম ম্যানেজার আমের খানকে। বললেন, ‘হামজা ও শমিতের জন্য পুলিশ কর্ডন নিশ্চিত করেছি। কারণ, ওদের তো একা ছাড়া যাবে না।’
কাবরেরার দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। আগের ম্যাচের একাদশ থেকে তিনটি পরিবর্তন আনেন সিঙ্গাপুর ম্যাচে। দলের মধ্যে এ নিয়ে নানা ফিসফাস শোনা গেছে। মনে যা–ই থাকুক, আমের খান মুখে বললেন, ‘প্রত্যেক কোচের নিজস্ব কৌশল থাকে। কখনো তা কাজ করে, কখনো করে না। এ নিয়ে কী আর বলব!’
কোচ হাভিয়ের কাবরেরার আজই সকালে স্পেনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা, তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। কবে ফিরবেন, তা ঠিক হয়নি। দুই সহকারী কোচ ও গোলকিপার কোচ কবে যাবেন, সেটা ঠিক হবে পরে। সেপ্টেম্বরে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের খেলা আছে, তাতে কাবরেরা থাকবেন কি না, সেটিও চূড়ান্ত নয়।
হঠাৎ জামাল ভূঁইয়া নামলেন লবিতে। বললেন, ‘গুলশান যাব খেতে।’ সুযোগ পেয়ে প্রশ্নটা করতেই হলো, ‘আপনাকে এক মিনিটও খেলাল না কোচ, কী হয়েছে?’ জবাব দিলেন সংক্ষিপ্ত, ‘কোচকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনিই ভালো জানেন। আমাকে কেন প্রশ্ন করছেন?’ জামালের অসন্তোষ পরিষ্কার বেরিয়ে এল এই তিনটি বাক্যে। এমন সময় লবিতে নেমে এলেন ফাহামিদুল ইসলাম। তাঁকে ঘিরে ধরলেন কয়েকজন ভক্ত। ছবির ফ্ল্যাশে আরও এক রাত যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। তারপর নামলেন তারিক কাজী। হাতে লাগেজ, গন্তব্য বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা। সেখানেই একা থাকেন তিনি একটি ফ্ল্যাটে। বসুন্ধরা কিংসের এই ফুটবলারের পায়ে এখনো সিঙ্গাপুর ম্যাচের চোটের ধকল। ২৫তম মিনিটে চোট পেয়েছিলেন, কিন্তু মাঠ ছাড়েননি। তাঁর সেই অদম্যতা নিয়ে ম্যানেজার যখন পাশে দাঁড়িয়ে প্রশংসা করলেন, তারিক হালকা হেসে বললেন, ‘কেন মাঠ ছাড়ব? যতক্ষণ পারি খেলব। দেশের জন্যই তো খেলি, তাই না?’ শব্দগুলো যেন রাতের নিস্তব্ধ লবিতেও একধরনের প্রতিধ্বনি হয়ে বেজে উঠল। দায়িত্বের আর ভালোবাসার।
ভুটান ম্যাচে দারুণ গোল করা সোহেল রানার দেখাও মেলে লবিতে। সিঙ্গাপুর ম্যাচে সুযোগ না পাওয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই একটু হাসলেন, উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন। বোঝা গেল মনে হতাশা থাকলেও কোচের বিরুদ্ধে কিছু বলে বিপদে পড়তে চান না।
ম্যাচের শুরুতে রাকিব এক প্রতিপক্ষকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরেছিলেন, ফাহামিদুলও ধাক্কা দিয়েছিলেন ম্যাচের একপর্যায়ে। টিম ম্যানেজমেন্টের একজন বলেন, ‘রাকিবের আচরণ ঠিক ছিল না। শুরুটা আমাদের ভালো হয়নি।’ রাত তখন পৌনে ১২টা। শহর কিছুটা ঘুমিয়ে পড়লেও হোটেলের লবি এক মুহূর্তে যেন জেগে উঠল। নিচে নামলেন হামজা চৌধুরী। এক ঝটকায় ভক্তদের ভিড় জমে গেল। রাত বলে যেন কিছুই আসে যায় না কারও! ছবি তোলার আবদার, হাত বাড়িয়ে শুভেচ্ছা, জার্সিতে অটোগ্রাফ নেওয়া সবই হলো।
ওদিকে জামাল ভূঁইয়া ছিলেন তাড়াহুড়োর মধ্যে, গন্তব্য গুলশান। ভক্তদের ভালোবাসায় হামজা আবিষ্ট হলেও শেষে জামালের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বিদায় জানালেন সবাইকে। তারপর দুজন একসঙ্গে উঠে গেলেন গাড়িতে। হোটেল লবিতে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন হামজার দুই ভাই আর এক বোন। তাঁরা গল্পে, আড্ডায় মেতে ওঠেন।
সিঙ্গাপুর ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে জাতীয় দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক তপু বর্মণের হাতে দেখা গেল একটি প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা লেখা, ‘তামিম নিখোঁজ’। এমন একটি বার্তা আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে কেন? কৌতূহল মিটিয়ে দলের ম্যানেজার জানান, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুরোধেই এটা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এএফসির (এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন) অনুমোদনও ছিল।