প্রভাত বিনোদন : নেতা ও অভিনেতা দুই ছিলেন ফারুক। ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধাও। দেশের মানুষের সেবা করার জন্য জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। তবে সবার আগে বলতে হবে তার অভিনয়ের কথা। অসাধারণ এই অভিনেতা জিতেছিলেন সাধারণের মন। হয়ে উঠেছিলেন অনন্য সাধারণ। গতকাল রবিবার ছিল এ অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
ঢালিউডে ফারুকের পরিচয় ছিল মিয়াভাই। শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় এই নামে সম্বোধন করতেন সবাই। আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ছয়দফা আন্দোলনের পর আমি ওয়ান্টেড ছিলাম, যে কারণে নাম দিয়েদিল ফারুক। ওরা বলল, এই নামে তোমাকে প্রথমে কেউ ধরবে না। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের নামগুলো ছোট হলে ভালো হয়, সুন্দর হয়, যেমন উজ্জ্বল, ফারুক, রাজ্জাক, আলমগীর, শাবানা। এ রকম ছোট নাম হলে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাওয়া যায়। ফারুক সত্যিই মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই জলছবি সিনেমার মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমায় নায়ক ফারুকের অভিষেক। তার অভিনীত শতাধিক সিনেমার সিংহভাগই ব্যবসাসফল। স্বাধীন বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে প্রায় সব শ্রেণির মানুষের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন এই নায়ক। তিনি যেসব সিনেমার মাধ্যমে নায়ক হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী, গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমণি, সূর্যগ্রহণ, আলোর মিছিল, লাঠিয়াল, সারেং বৌ, সাহেব, লাঠিয়াল, মিয়া ভাই উল্লেখযোগ্য।
ফারুক অভিনীত অধিকাংশ চরিত্রই এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতো। সেই সময়ের গ্রামীণ অর্থনীতিনির্ভর বাংলাদেশের গ্রামীণ তরুণ-যুবকের চরিত্রে অভিনয় করতেন তিনি। তার সিনেমা দেখে সেই সময়ের যুবকেরা উদ্দীপ্ত হতো। পেত সমাজ ও দেশ গড়ার প্রেরণা। সেই সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির গল্পে ফারুক প্রতিবাদী যুবক হয়ে ধরা দিয়েছেন। ফলে মানুষের হৃদয়ে সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তিনি।
ফারুক অভিনীত নয়নমণি, সুজন সখী, গোলাপী এখন ট্রেনে সিনেমাগুলোতে তাকে দেখা গেছে প্রতিবাদী চরিত্রে। অনিয়মের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন তিনি। এ কারণে তার সিনেমাগুলো সাধারণ দর্শককে টেনে নিয়ে যেত প্রেক্ষাগৃহে।
‘মিয়া ভাই’ সিনেমার পর তিনি সবার মিয়া ভাই হয়ে যান। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। চলচ্চিত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরির গুরুত্ব দেখা দেয়। এতে এগিয়ে আসেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের অন্যতম ছিলেন নায়ক ফারুক।
ফারুকের প্রথম সিনেমা জলছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন কবরী। দর্শকদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলে ছবিটি। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় সেটি। এরপর ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ ও ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল নামের দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
অন্যদিকে ১৯৭৫ সালে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত তার অভিনীত সুজন সখী ও লাঠিয়াল সিনেমাদুটি ব্যবসাসফল হয়। লাঠিয়াল সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
সংসদ সদস্য হওয়ার পর ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। পরীক্ষায় তার রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এরপর মস্তিষ্কেও সংক্রমণ ধরা পড়ে। আট বছর ধরে ওই হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যর্থ করে ২০২৩ সালের ১৫ মে তিনি মারা যান। ফারুকের জন্ম মানিকগঞ্জের ঘিওরের একটি গ্রামে। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের ছিল পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ফারুক ছিলেন দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট। ফারুক বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়।