ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশে গঠন হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর এই সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইনের আওতায় বাস্তবায়িত সব প্রকল্প ও চুক্তি অব্যাহত ও চলমান কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার কথা। বলাই বাহুল্য যে, সদ্য বিদায়ী সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ঘটেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক দেনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছে; দেউলিয়া হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠান। এই দায়দেনা তৈরি হওয়ার মূলে রয়েছে সরকারের অনৈতিক সুবিধা ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ২ ও ৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছে। ব্যবসায়িক সুবিধা দেয়ার নিমিত্তে ব্যয়বহুল সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে এই খাতের অনেক ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন। এছাড়া গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে লাখ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্টও দেয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগ নিয়ে গেছে গুটিকয়েক কোম্পানি। আবার আর্থিক লোকসান ও সংকটের কথা বলে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম; যার চাপ পড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতে সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ আইনের আওতায় ১৪ দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। এর পরও ২০০৮-০৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৭০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। পাশাপাশি সরকারি কোষাগার থেকে সংস্থাটিকে ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় মেটাতে বিশেষ বন্ড ছাড়তে বাধ্য হয় এই সরকার। এ অবস্থায় নতুন সরকারের উচিত সে সময় যেসব প্রকল্প ও চুক্তি হয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা এবং গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা বিরাজ করছে সেগুলো দূর করা। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় চুক্তি বাতিল ও ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনা। বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মতে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে স্বাভাবিক সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। সর্বোচ্চ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার ধরলেও প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্র বসে থাকছে। এই কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও বিদায়ী সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। তার পরও বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছিল এ সরকার। অব্যবহৃত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বাড়তে থাকে। আর বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় ভোক্তার ওপর আর্থিক চাপ বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে খাতটির অযৌক্তিক ব্যয় সবার আগে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। কোনো গোষ্ঠীস্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন তখনই দেখা যাবে যখন বিদ্যুতের দাম কমে আসবে। পুরনো প্রকল্প ও চুক্তি যাচাই-বাছাইয়ের পাশাপাশি উৎপাদন বন্ধ থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। প্রকল্প গ্রহণের আগে সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই বা নির্মিত প্লান্টগুলোয় জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার ছিল। তাহলে কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন হতো না। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে করা চুক্তি, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বণ্টনের জন্য গ্রিড ব্যবস্থার উন্নয়ন না করা—এমন সব কারণ ছাড়াও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে এ সমস্যার কোনো সমাধান আসছে না।
২০১০ সালে দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি আইন করা হয়েছিল। এই আইন অনুসারে, বিদ্যুৎ খাতের ইউনিটপ্রতি দাম ও খরচের মডেল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে ছিল। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি স্বল্প সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনেও গুরুত্ব দেয়া হয়। মূলত বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্যই এই ধরনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অনেক বেশি আগ্রহ লক্ষ করা গেলেও প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে তোলা যায়নি। ফলে সর্বনি¤œ খরচে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়নি। প্রতিযোগিতা না থাকায় বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে এমন একচেটিয়া ও শোচনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই খাতে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে বিদ্যুৎ খাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্ষমতা—এসব কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। তৎকালীন সরকার যখন বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের ব্যবসায় নিয়ে আসে, তখন তারা কোনও প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করেনি। ফলে তারা কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, কত লাভ করছে, কেউ তা জানে না। সুতরাং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন বা সরবরাহ লাইন উন্নয়নেও সরকারের পদক্ষেপ কাম্য। উন্নত সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসবে বলে আশা করা যায়। এতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমে আসবে। দেশের বিদ্যুৎ খাত দীর্ঘকাল ধরে একটি বড় গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি। তবে এখন সরকার বদল হওয়ায় এই খাতের জিম্মিদশা কাটবে বলে প্রত্যাশা রাখি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নতুন সরকার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে বলেই সবার প্রত্যাশা।