সম্পাদকীয় : চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, বন্যায় মৃত লোকসংখ্যা প্রতিদিনই বাড়াছে। এরমধ্যে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত যে ৭১ জনের তথ্য পাওয়া যায় তার পুরুষ ৪৫ জন, নারী ৭ জন ও শিশু ১৯ জন। কুমিল্লায় ১৯, ফেনীতে ২৮, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ১১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১, কক্সবাজারে ৩ ও মৌলভীবাজারে ১ জন মারা গেছেন। এখনও মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। এখনও ৫ লাখ ৮২ হাজার ১৫৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মোট লোকসংখ্যা ৫০ লাখ ২৪ হাজার ২০২ জন। সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়ি-ঘরে ফিরছেন। এখনও ৩ হাজার ৬১২টি আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৬ জন লোক এবং ৩১ হাজার ২০৩টি গবাদি পশু রয়েছে বলেও জানিয়েছেন আলী রেজা। বলাই বাহুল্য যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সাধারণত শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশ অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে সম্প্রতি আমাদের দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলায় ২ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলমান বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশুরা। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে, গত ৩৪ বছরের মধ্যে এবারের বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহ। এতে দুর্গত অঞ্চলের অন্তত ২০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। লাখ লাখ শিশু ও তাদের পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। তাদের কাছে কোনো খাবার কিংবা জরুরি ত্রাণসামগ্রী নেই।
অবশ্য সরকারি লোকজন ও স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছু এলাকায় সাহায্য পৌঁছে দেয়াটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌসুমি বৃষ্টি অব্যাহত থাকার কারণে আগামী দিনে আরো অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, বন্যার শুরু থেকেই তারা সক্রিয়ভাবে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, মুখে খাওয়ার স্যালাইনসহ জরুরি সেবাসামগ্রী সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু সব শিশুর কাছে পৌঁছাতে এবং শিশুদের ভবিষ্যতের ওপর চলমান এ সংকটের বিধ্বংসী প্রভাব রোধ করতে আরো তহবিল প্রয়োজন। ইউনিসেফের শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি ইনডেক্স (চিলড্রেনস ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স) অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিশুরা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ও পরিবেশগত ঝুঁকির শিকার। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যা, দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা এবং মে মাসের ঘূর্ণিঝড় রেমালের মতো দুর্যোগগুলো খুব কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। ৩টি জরুরি পরিস্থিতির কারণে সব মিলিয়ে ৫০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এ পরিস্থিতিতে বন্যার্ত শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি।
এরই মধ্যে ইউনিসেফ অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার শিশুসহ ৩ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এসব মানুষের মধ্যে তারা জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন উপকরণ, যেমন পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, পানি ধরে রাখার জন্য জেরি-ক্যান এবং ওরাল ডিহাইড্রেশন সল্ট (মুখে খাওয়ার স্যালাইন) ব্যাগ বিতরণ করেছে। তবে তাদের মতে, এর বাইরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও শিশুদের জন্য আরো সহযোগিতা প্রয়োজনÑ নগদ সহায়তা, নিরাপদ খাবার পানি, স্বাস্থ্যবিধি উপকরণ (হাইজিন কিট), জরুরি ল্যাট্রিন তৈরি, স্যানিটারি প্যাড, মুখে খাওয়ার স্যালাইন ও জীবন রক্ষাকারী জরুরি ওষুধ। এছাড়া অসুস্থ নবজাতক ও শিশুদের চিকিৎসার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং গর্ভবতী মায়েরা যেন নিরাপদে তাদের সন্তান জন্ম দিতে পারেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় সেবা কার্যক্রম অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। সংস্থাটির এই সুপারিশ যথোচিত। আজকের শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ এ কথা সর্বজনবিদিত। একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ভিত গড়ে ওঠে শৈশবে। সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিক বন্যায় দুর্গত এলাকার শিশুদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ বিঘিœত হয়েছে। মারা গেছে সাত শিশু।
বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় সাধারণত বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। এর মধ্যে পানি ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের সংখ্যা বেশি। বড়দের চেয়ে শিশুরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, চর্মরোগসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এ ধরনের রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। বন্যার সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়। তাই জ্বর অবহেলা করা যাবে না। ডেঙ্গুর উপসর্গ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য গণসচেতনতা বাড়ানোয় কাজ করতে হবে। যারা এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে আর যারা বাড়ি ফিরে গেছে সবাইকে সচেতন করা প্রয়োজন। এছাড়া সব শিশুসহ কোনো নবজাতক যেন বড় হয়ে অসুস্থ ও অপুষ্টিতে না ভোগে সেজন্য এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ত্রাণ যেন যায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে, যেমন শিশুখাদ্য। পাশাপাশি নবজাতকরা যেন শালদুধ পায় সেজন্য মায়েদের পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করা জরুরি। শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম পূর্বশর্ত মায়ের সুস্বাস্থ্য। সুতরাং এ বিষয়েও মনোযোগী হতে হবে।
শারীরিক সুস্থতার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে মানসিক সুস্থতা। প্রচলিত আছে, সুস্থ দেহে সুস্থ মন। তাই শরীরের সুস্থতা সর্বাগ্রে জরুরি। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলা করার সুযোগ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ভালো থাকার অর্থ হলো শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকা। সুতরাং বন্যার্ত শিশুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় ৩ দিক থেকেই কাজ করতে হবে। সুস্থ দেহে ভয়, হতাশা, বিষণœতা, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত মন সমাজের নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে। বন্যায় লাখ লাখ শিশুর বাড়িঘর, স্কুল, পরিবারের ফসলি জমি প্লাবিত হয়ে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে শরীরসহ তাদের মননে, সামাজিক অবস্থানে। বিশেষ করে, কেউ যেকোনো দুর্ঘটনা, দুর্যোগের শিকার কিংবা কাছের কারো মৃত্যু এমন ধরনের ভীতিকর ও কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে শিশুদের আচরণে আতঙ্ক, ভয়, ক্রোধ ইত্যাদি প্রকট হতে পারে। উদ্বেগ বাড়তে পারে যা শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে। পিটিএসডি কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সময়ই যে হয়, এমন নয়। এটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করার কয়েক মাস পর থেকে শুরু হতে পারে। এজন্য এখনই বন্যার্ত শিশুদের মন প্রফুল্ল রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করাও আবশ্যক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা