সম্পাদকীয়
অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা দেশের বিভিন্ন ফোরম থেকে এখন বলা হচ্ছে যে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বিদ্যমান। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আনুপাতিক হারে কমেছে বরাদ্দ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের বড় অংশই যায় পেনশনে। আবার সামাজিক নিরাপত্তাভোগীদের বড় অংশই ভুয়া ও অস্তিত্ববিহীন। সড়ক ও রেলসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে যে ব্যয় হয়েছে, তা-ও কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ে বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও উৎপাদন ব্যয়ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। ঘোষিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর ২ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল করা। যদিও কর ও শুল্ক ছাড়ের ঘোষণায় পণ্যের দাম কমেনি। উল্টো অর্থবছরের প্রথম মাসে প্রতিটি পণ্যের দাম আরো বেড়ে যায়। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকে, যা দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুলাইজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সংঘাত-সংঘর্ষের জের ও সরকারের নেয়া পদক্ষেপে অর্থনীতিতেও ছিল নজিরবিহীন স্থবিরতা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা মানুষ। ডলার সংকট, রিজার্ভের বড় ক্ষয়সহ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপদে ছিল দেশ। এর পরও প্রতিবারই ঘোষিত বাজেটের আকার আগেরবারের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর ৭ মাসের শাসনামলে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। ফলে বাজেটের বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে ঋণের দায় পরিশোধে। এভাবেই চলেছে সরকারের বড় আকারের বাজেট। বাজেটের একটি বড় অংশই চুরি ও দুর্নীতি হয়েছে। বিদেশেও পাচার হয়েছে অর্থ। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের বাজেটে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। দেশের বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই প্রণীত হয়েছে জনবিমুখ এ বাজেট। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে বাজেটে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিবর্তন এনে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
জণকল্যাণে নতুন যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা হলো মূল্যস্ফীতি কমানো, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা, রাজস্ব আহরণের বাস্তবভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ অর্জনযোগ্য মূল্যায়ন করা, খেলাপি ঋণ আদায় ও খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা ও জনগণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা কমানো। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ-পানিসহ যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন। ৩০ জুন চলতি অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস হয় সংসদে। সেখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আর ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে ঘাটতি বাজেট। এ ঘাটতি মেটানোর কথা ব্যাংকসহ দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হিসেবে। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও অর্থবছরের প্রথম মাস তথা জুলাইয়েই মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী)। উন্নয়ন প্রকল্পসহ পরিচালন খাতে সরকারের অপব্যয় ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর পড়ছে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। আবার সেসব পণ্যের ওপর শুল্কও বেশি হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ধনীদের কাছ থেকে কর আহরণে ব্যর্থতার কারণে মূল্য সংযোজন করের (মূসক) ওপর সরকারকে বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে কর ফাঁকি দেয়া কালো টাকার মালিকদের প্রায় প্রতি বছরই অর্থ বৈধ করার নামে অন্যায্য সুবিধা দেয়া হয়, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটেও বহাল রয়েছে।
দেশের আর্থিক খাতের হৃৎপি- ব্যাংক খাত। সরকারের ঋণ গ্রহণ, পুনঃতফসিল, অবলোপন ও বেনামি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক। গত মার্চের শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। যদিও ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেনামি ঋণ, পুনঃতফসিলকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণসহ আদায় হবে না এমন ঋণের পরিমাণ অন্তত ৭ লাখ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাজেটকে পরিবর্তন ও সংস্কার করে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাজেটে ব্যাংক খাত পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে ও খেলাপি ঋণ আদায়, উন্নয়ন প্রকল্পসহ পরিচালন খাতে সরকারের অপব্যয় ও দুর্নীতি রোধ করে প্রয়োজনীয় জোরালো পদক্ষেপের ঘোষণা আসা উচিত। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবা আরও সাশ্রয়ী করতে হবে। জনগণের ওপর করের বোঝা কমিয়ে মূল্য সংযোজন করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরকারকে প্রত্যক্ষ করের হার বাড়ানোয় জোর দিতে হবে। মানুষ স্বস্তিতে থাকবে। আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানÑ বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়Ñ সেগুলোয় প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার করে শক্তিশালী করাও জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।