মুনতাসির মামুন : সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন নিয়ে নানাবিধ আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এরই মাঝে হতাহতের সংখ্যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে এই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা ৬৫০ জন। ১৬ জুলাই থেকে ১১ অগাস্টের হিসাব এটি। আমাদের গণমাধ্যম বলছে ৮১৯। যত দিন যাচ্ছে, আন্দোলনের সময় আহতদের কেউ কেউ মারা যাচ্ছে এবং সংখ্যাটাও একটু একটু করে বাড়ছে। সংখ্যা যতই হোক, সত্য হলো অনেক মানুষের মৃত্যু। বলা যায় অকাল মৃত্যু। আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থীরাই হতাহতের পরিসংখ্যান রাখার জন্য অনলাইনভিত্তিক টালিখাতা তৈরি করেছেন। যার নাম শহীদডটইনফো এই ওয়েবসাইটে আন্দোলনে মৃত্যূবরণকারীদের নাম, পরিচয়, পেশা ইত্যাদি কিছু তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে। আমি যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত এই ওয়েবসাইটে ৪১১ জনের ক্ষুদ্র বিবরণ দেখা যায়, তাতে মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছাত্র, বাকিদের মধ্যে নি¤œ আয়ের মানুষই বেশি। এই আন্দোলন যদিও ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত এবং তাদের দাবির উপর ভিত্তি করে, তবুও এতে আপামর জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ দেখা যায়। মৃতের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে সেখানে অর্থনৈতিকভাবে নতজানু, যাদেরকে আমরা নি¤œবিত্ত জনগোষ্ঠী বলে থাকি তাদের সংখ্যা উল্লেখ্যযোগ্যহারে চোখে পড়ার মতো। জাতি যখন শোক প্রকাশ করছে, তখন এই ট্র্যাজেডির দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতেও। ঠিক যেমনটি ‘দ্য বেল কার্ভ’ গ্রন্থটি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বুদ্ধিমত্তা এবং শ্রেণি নিয়ে আলোচনা করেছিল।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিক ‘দ্য বেল কার্ভ: ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ক্লাস স্ট্রাকচার ইন আমেরিকান লাইফ’ গ্রন্থটির মূল যুক্তি হলো বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ), বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন, কর্মক্ষমতা, আয় এবং সামাজিক শ্রেণি। রিচার্ড জে. হার্নস্টেইন এবং চার্লস মারে তাদের এই গ্রন্থে বুদ্ধিমত্তাকে একটি প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরেছিল যা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাফল্য নির্ধারণ করে। লেখকদের মতে, সমাজ ক্রমশ জ্ঞানভিত্তিক বিভক্ত হয়ে পড়ছে। যেখানে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ফলাফলের পূর্বাভাস দেয় বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখায় যে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে শুধু বুদ্ধিমত্তাই নয়, বরং ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থানও তার ভাগ্য নির্ধারণ করে।
অর্থনৈতিক স্তরবিন্যাস এবং ঝুঁকিপূর্ণতা : ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের সময় অনেক ছাত্র এবং নি¤œ আয়ের মানুষের মৃত্যু একটি কঠিন বাস্তবতার দিকনির্দেশ করে। সংকটের সময়ে অর্থনৈতিক অবস্থান গুরুতরভাবে ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করে। বেশিরভাগ ছাত্রই আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকেন এবং তাদের কাছে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার মতো কোনো সম্পদ বা অবস্থান থাকে না। আমরা অনেকেই মনে করি এটা বয়সের দোষ। এই তত্ত্ব ফেলে দেবার নয়। শহীদডটইনফো থেকে পাওয়া তথ্য এই তত্ত্বকে বেশ পোক্ত করে যে মৃত্যের গড় আয়ু ৩০-এর অনেক নিচেই হবে, যেহেতু তালিকায় ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি।
অন্যদিকে, নি¤œ আয়ের মানুষেরা অর্থনৈতিকভাবে এমন একটি অবস্থানে থাকেন যারা স্বাভাবিকভাবেই অনিরাপদ। তাদের অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা যেকোনো অস্থির সময়ে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কম বিকল্প এবং কম সক্ষমতা দেয়। ‘দ্য বেল কার্ভ’ গ্রন্থে হার্নস্টেইন এবং মারে যুক্তি দিয়েছেন, আমেরিকান সমাজে বুদ্ধিমত্তা একজনের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, বাংলাদেশি আন্দোলনের ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা আমাদের দেখায় যে, বুদ্ধিমত্তার চেয়ে অর্থনৈতিক দারিদ্র্য রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় মানুষকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। লেখকরা যুক্তি দেন যে বুদ্ধিমত্তা অনেকটাই বংশগত এবং একজন ব্যক্তির জীবনে সাফল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা আরও প্রস্তাব করেন, সমাজ ক্রমশই জ্ঞানভিত্তিক ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধ হচ্ছে, যার ফলে ‘জ্ঞানী এলিট’ এবং কম আইকিউসম্পন্নদের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান বিভাজন তৈরি হচ্ছে।
গ্রন্থটি বিতর্কিত, কারণ এটি বর্ণ এবং বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে, যেখানে তারা স্পষ্টত ইঙ্গিত দেয় যে, সমাজের নানা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গড় আইকিউ স্কোরের পার্থক্য থাকে। সমালোচকরা যুক্তি দেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষতিকর, স্টেরিওটাইপকে শক্তিশালী করে। পাশাপাশি এটা বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য সামাজিক কারণগুলোর, যেমন অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা এবং সম্পদের প্রাপ্যতার প্রভাবকে উপেক্ষা করে। সামগ্রিকভাবে, ‘দ্য বেল কার্ভ’ গ্রন্থটির প্রস্তাব হলো সামাজিক বৈষম্য এবং আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রে শ্রেণি কাঠামো বোঝার জন্য বুদ্ধিমত্তা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং এটি একটি সমাজের পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে যা ক্রমশই বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা দ্বারা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দুই দেশের আর্থসামাজিক মানদ- মোটেও এক নয়, তবুও বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক শ্রেণি বিন্যাসের বাস্তবতা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই যে সীমাবদ্ধ নয় তা আমাদের নতুন করে বলতে হয় না।
স্বৈরাচারী শাসন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ভূমিকা : স্বৈরাচারী শাসন প্রায়ই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধারাবাহিকভাবে ভিন্নমতকে দমন করে এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী একটি বড় নি¤œ আয়ের গোষ্ঠী তৈরি ও লালন করে, যারা অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত এবং সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ থাকে। এই শাসন প্রায়ই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যারা শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী তাদের দ্বারা প্রান্তিকদের নিয়ন্ত্রণের বৈধতা দেয়। এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে, শাসনের নীতিমালা সমর্থন করে যা অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এলিটদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং তথাকথিক অর্থনীতির ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার বয়ান প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দমন করে। যেকোনো স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে জনসংখ্যার একটি উল্লোখযোগ্য অংশ দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকা পড়ে থাক। বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, যা প্রায়শই এই ধরনের অবস্থা থেকে সুবিধা লাভ করে এবং নিজেদের স্বার্থপন্থী নীতিগুলোর পক্ষে সর্মথন দেয় যা সামাজিক স্তরবিন্যাসকে প্রকট করে। এখানে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি কর্তৃক তৈরিকৃত শিক্ষাব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক নীতিমালাগুলো এই জ্ঞানভিত্তিক শ্রেণি বিন্যাসের ফারাক আরও বাড়িয়ে তোলে।
এইভাবে তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত একটি গোষ্ঠীকে শাসনের স্বার্থে বিভিন্নভাবে কাজ লাগানো হয়। একটি জনগোষ্ঠী, যারা মৌলিক চাহিদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে, তারা সাধারণত স্থিতিশীলতার সময়ে শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে কম আগ্রহী হয়। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে, এই একই জনগোষ্ঠী পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী শক্তি হয়ে ওঠে। যখন একটি সুযোগ আসে সিস্টেমটিকে ভেঙ্গে ফেলার, যে সিস্টেমটি তাদের কষ্টের কারণ, তখন নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠী প্রায়শই প্রতিরোধের প্রথম সারিতে চলে আসে। যাদের আমরা ফার্স্ট রেসপন্ডার বলতে পারি। দৈনন্দিন জীবনের যেকোনো সমস্যার প্রথম আঘাত আসে এই প্রান্তিক বা নি¤œবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর। আর তাই সমাজের অন্যান্য অংশীজনের দ্বারা কোনো আন্দোলন পরিচালিত হলেও নিজেদর ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের একটি গভীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় বা বিদ্যামান কাঠামোগুলোকে পাল্টে দেয়ার সুযোগ দেখতে পায়।
কেন নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠী বিপ্লবে যোগ দেয় : ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে নি¤œ আয়ের মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ঐতিহাসিক বিপ্লব এবং সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চমকপ্রদ কোনো ঘটনা নয়। প্রায়শই, যারা অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক তারাই সবার আগে এগিয়ে আসে শুধু একটি উদ্দেশ্যে যে, যদি একটি অত্যাচারী শাসনের পতন হয় তবে তাদের ভাগ্যোন্নয়নের পথ খুলে যেতে পারে। বাংলাদেশের আন্দোলনটি ছাত্রদের দাবি দ্বারা পরিচালিত হলেও, নি¤œ আয়ের অংশগ্রহণকারীরা এটিকে এমন একটি সুযোগ হিসাবে দেখেছিল যা তাদের দারিদ্র্য এবং নিরাপত্তাহীনতা অব্যাহত রাখতে থাকা ব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারে। অনাগত ভবিষ্যৎ বর্তমানের চেয়ে ভালো হতে পারেÍ এই তাগাদা থেকে তারা মাঠে নামেন। অর্থনৈতিক বঞ্চনা প্রায়ই হতাশা এবং ক্ষোভের দিকে মানুষকে পরিচালিত করে। অনেক নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থা নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সামান্যই আশার আলো দেয়। একটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ, এমনকি এমন একটি আন্দোলন যা তাদের সরাসরি উদ্বেগের কারণ নয়, তাদের দুঃখ-দুর্দশা প্রকাশ করার একটি উপায় হয়ে ওঠে বৃহত্তর বৈষম্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে। কাঠামোগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা, যদিও তা অন্য কেউ শুরু করে, তাদের জন্য তাই যথেষ্ট যে তারা তাদের অংশগ্রহণ ভবিষ্যৎ জীবনে হয়তো কোনো পরিবর্তন আনতে পারে।
সাম্প্রতিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ছাত্র এবং নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য। এর কারণ খুঁজলে দেখা যায়, তাদের নিজ নিজ অর্থনৈতিক অবস্থানের অভিজ্ঞতা প্রায় একই। এখানে আমরা কিছুটা দ্বিমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু যদি যুক্তি দিয়ে ভাবা যায়, আর্থিক ক্রয় সক্ষমতার মানদ-ে একজন সাধারণ ছাত্র এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর কারও মধ্যে অর্থনৈতিক তফাৎ খুব একটা থাকে না। দিন আনি দিন খাই (আমেরিকানদেরও এমন একটি প্রবাদ আছে, পে চেক টু পে চেক) বলে যে প্রবাদ আছে তাতে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে তুলে ধরে। ঠিক তেমনই একজন ছাত্র তার দৈনিক খরচার থেকে খুব বেশি অর্থের মালিক হয় না বা তার কাছে বাড়তি কোনো কিছু করার বা কেনার জন্যে মুখাপেক্ষী (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিভাবকের কাছে হাত পাততে হয়) হতে হয়। এই সাধারণ ক্ষেত্রটি একটি যৌক্তিক জোটবদ্ধ গোষ্ঠী তৈরি করে যেখানে উভয় গোষ্ঠীই একসঙ্গে দাঁড়ালে একটি ভালো ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখতে পায়।
শ্রেণি কাঠামো এবং প্রান্তিকদের আত্মত্যাগ : ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিকদের মধ্যে মৃত্যুর ঘনত্ব একটি বৃহত্তর সামাজিক বিভাজনের দিকনির্দেশ করে। যারা সীমিত অর্থনৈতিক সক্ষমতা রাখে তারা প্রায়শই সরকারি ব্যর্থতা এবং সামাজিক অস্থিরতার প্রধান ভুক্তভোগী হয়। যা আমরা আগেও দেখেছি। এই অর্থে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সন্ধানে কে সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করবে তা নির্ধারণে অর্থনৈতিক শ্রেণি একটি মূল কারণ হয়ে ওঠে। এই গতিশীলতাকে ‘দ্য বেল কার্ভ’ গ্রন্থে আলোচনা করা বুদ্ধিভিত্তিক শ্রেণি কাঠামোর একটি সম্প্রসারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, যেখানে সামাজিক স্তরবিন্যাস অসমতার দিকে ধাবিত করে। তবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তা নয় বরং অর্থনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করে যে, কে সবচেয়ে বেশি সফল হবে বা হতে পারে এবং কে সব থেকে বেশি সহিংসতার মুখে পড়বে বা পড়তে পারে। প্রান্তিকরা, যেহেতু তাদের সীমিত সম্পদ থাকে, রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিণতি থেকে পালানোর বা প্রতিরোধ করার উপায় বা অপশন কম পায় বলেই ধরে নেয়া যায়। তাই মৃত্যুর মতন ঘটনা এই গোষ্ঠীর মধ্যেই বেশি দেখা যাওয়ার সম্ভবনাও বেশি থাকে।
সাম্প্রতিক এই আন্দোলনসহ ইতিহাসের বেশিরভাগ আন্দোলনে হতাহতের চিত্র আমাদেরকে ‘দ্য বেল কার্ভ’ গ্রন্থের যুক্তিগুলোকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পুনঃমূল্যায়ন করতে উদ্বুদ্ধ করে। হার্নস্টেইন এবং মারে বুদ্ধিমত্তাকে সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্তরবিন্যাসের মূল চালক হিসাবে তুলে ধরেছেন। যদিও বাংলাদেশের ঘটনাচিত্র দেখায় যে, একজন ব্যক্তির নিজ জীবনের ঝুঁকির ওপর অর্থনৈতিক শ্রেণির গভীর প্রভাব রয়েছে। এটি ভাবতে বাধ্য করে যে, বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কারণগুলো সামাজিক অস্থিরতার সময়ে কোন জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে তা নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রন্থটির সঙ্গে তুলনার কারণ : ধরে নেয়া যেতেই পারে অনেকেই গ্রন্থটি সম্পর্কে অবগত নন। তার কোনো প্রয়োজনীয়তা বা বাধ্যবাধকতাও নেই। যদি বলা হয়, কৃষ্ণবর্ণের কেউ শ্বেতবর্ণের থেকে কম বুদ্ধিসম্পন্ন এবং এ কারণেই শ্বেতবর্ণের জনগোষ্ঠী বেশি উন্নত। আমরা না জেনেও হয়তো এই বক্তব্যে সহমত প্রকাশ করতে পারি। হার্নস্টেইন এবং মারে তাদের গ্রন্থটিতে এই আন্দাজকৃত সত্যটাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যখ্যা করেছেন এবং প্রমাণও দিয়েছেন। আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া আন্দোলনের সঙ্গে এই গ্রন্থের তত্ত্বের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে মাত্র। এই তুলনার সঙ্গে কিছু অন্বেষণও থাকছে। যেমন অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক বৈষম্য এবং এর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। ‘দ্য বেল কার্ভ’ গ্রন্থটি যেখানে বুদ্ধিমত্তাকে সামাজিক ফলাফলের প্রধান সূচক বলা হচ্ছে সেখানে আমরা আমাদের সামাজিকতায় দেখতে পাচ্ছি অর্থনৈতিক কারণগুলোরও বিশেষ অবদান আছে। যা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় কারা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে তা নির্ধারণ করে।
সামাজিক কাঠামোগুলোকে পুনর্মূল্যায়নের আহবান : এই ব্যপারটা অনেকটাই ক্লিশে। আমরা সবাই জানি কী করতে হবে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলন আমাদের সমাজের গভীরভাবে নিহিত বৈষম্যের একটি কঠিন স্মৃতি। এই সময়ের মধ্যে ছাত্র এবং নি¤œ আয়ের ব্যক্তিদের অসামান্য আত্মত্যাগ আমাদের সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণি ব্যবস্থাগুলো কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে পুনরায় বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। আমরা এই ট্র্যাজেডি নিয়ে চিন্তা করে দেখতে পাই এই সংগ্রাম শুধু নির্দিষ্ট দাবির বিষয়ে নয়, এটি একটি স্বৈরাচারী শাষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যা সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য এবং প্রান্তিকতাকে ক্রমাগতভাবে পোক্ত করে আসছিল। ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ একটি ন্যায়বিচার এবং একটি ভালো ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে যা শুধু কোনো একক কারণকে ছাড়িয়ে যায় এবং মানবিক মর্যাদা ও ন্যায্যতার সার্বজনীন আকাঙ্ক্ষার কথা বলে।
এই আন্দোলন এবং এতে যে জীবনগুলোর অকাল প্রয়াণ হয়েছে, তা আমাদেরকে শুধু ব্যক্তি ক্ষমতার ওপর ফোকাসের বাইরে যেতে বাধ্য করে। সামাজিক সংকটের সময়ে কারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হবে তার ওপর অর্থনৈতিক অবস্থানের গভীর প্রভাবকেও আমাদের স্বীকার করতে হবে। এর মাধ্যমে, আমরা এমন একটি সমাজ গঠনের দিকে অগ্রসর হতে পারি যেখানে এই ধারণা পাল্টে যাবে এবং বৈষম্য কমে আসবে। যারা জীবন হারিয়েছেন তাদের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে, আমাদেরকে অবশ্যই এই কাঠামোগত বৈষম্যগুলো দূর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক সংস্কারের আহবান নয় বরং একটি ন্যায়সঙ্গত সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য আহবানও। যেখানে একজন ব্যক্তির জীবন এবং সম্ভাবনাকে তার অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করতে না হয়।
লেখক : সমন্বয়ক, বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনার কোস্টাল ক্লিনআপ