বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
Proval Logo

দেশের ব্যাংক খাত পরিচালিত হয়েছে  সুবিধাভোগী লোকজনের দ্বারা

প্রকাশিত - ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪   ০৯:২৪ পিএম
webnews24

প্রভাত বাণিজ্য : আমলাদের নানা সুযোগ-সুবিধা ও অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা ছিল সংসদে জনপ্রতিনিধিদের চেয়েও বেশি। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমলাদেরও মন্ত্রীদের মতো জনসাধারণের করের টাকা নিজের বাবা-মায়ের নামে নানা প্রতিষ্ঠান তৈরির উদাহরণ আছে। সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নিজ গ্রামে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অর্থায়নে মায়ের নামে করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। একই সুবিধা পেয়েছেন আমলারাও। সাবেক সমাজকল্যাণ সচিব জুয়েনা আজিজের নানা-নানির নামে নোয়াখালীতে ফেরদৌস-মজিদ প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্র ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
দেশের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের বিভাগের পাশাপাশি আর্থিক খাতে লুটপাত, অনিয়ম, অর্থপাচারসহ নানা ধরনের কর্মকা- পরিচালিত হয়েছে গত দেড় দশকে। আর এসব কাজে সরকারকে পরোক্ষভাবে সহযোগিতার অভিযোগ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরদের। এর মধ্যে অধ্যাপক ড. আতিউর রহমানের আমলে অনুমোদন পায় নতুন নয়টি ব্যাংক। আর ফজলে কবিরের অনুমোদন পায় আরো চারটি। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরও সুযোগ দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। 
শেখ হাসিনা সরকারকে দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন উপাদান সক্রিয় ছিল, এখনো আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ। তিনি  গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের এখানে ফ্যাসিস্ট উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। সেই সঙ্গে তাদের চেষ্টাও ছিল। একই সঙ্গে তারা এর ওপর ভরসা করেই টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। তারা ক্ষমতায় থাকায় সিভিল-মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসিকে হাতে রাখার জন্য যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেয়া সেটি দিয়ে রাখতে হয়েছে। এর পাশাপাশি জনগণের সফট বিষয়গুলো ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মের ব্যবহার। এ ধরনের শাসনের সময় একদিকে বল প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে মানুষের সফট বিষয়গুলোয় আধিপত্য বিস্তার করা। এ ধরনের শাসকগোষ্ঠীর বড় একটি সমর্থক থাকে। যেমন আইয়ুব খানের সময় স্বৈরতন্ত্র ছিল কিন্তু জনগণের সমর্থন এই পর্যায়ে ছিল না। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্যদিকে ধর্ম দুটিকেই কাজে লাগিয়েছে। এর ওপরই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু জনগণের ক্ষোভের মাত্রা এবং তাদের ভূমিকা থেকেই আজকে এ অবস্থাটি তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার গত দেড় দশকে একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রশাসন কর্মকর্তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমলাদের পাশাপাশি চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। এজন্য পুরস্কার বা টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে অর্থ, ক্ষমতা, প্লট ও প্রাইজ পোস্টিং। 
বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন নিয়ে রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য শুধু রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভর করেনি। আমলা-পুলিশের ওপরেও ব্যাপকমাত্রায় নির্ভরতা ছিল। বিভিন্ন সেক্টরে ছিল সুবিধাবাদী লোক। দেশের ব্যাংক খাত পরিচালিত হয়েছে সুবিধাভোগী লোকজনের দ্বারা। লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকগুলো থেকে তছরুপ হয়েছে। এস আলমের মতো গ্রুপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো রকম অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করে ঋণ নিয়েছে। গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যে ৯০ শতাংশই বিদেশে নিয়মবহির্ভূতভাবে সম্পদ গড়েছে। ওয়াসার এমডিকে সাতবারের মতো নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব কাজ যারা করেছে তাদের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল। কাজেই এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দলের সম্পর্ক হয়েছে।’
দেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তে সহযোগীদের রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পের প্লট দিয়ে পুরস্কৃত করার সংস্কৃতিটি চালু হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। আর তা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় শেখ হাসিনার গত দেড় দশকের শাসনামলে। এর একটি বড় উদাহরণ হলো পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের বিষয়টি। সেখানে জমির কাঠাপ্রতি গড় দাম এখন কোটি টাকার বেশি। এ প্রকল্পের জমি সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছেন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। কোটা সুবিধায় প্রকল্পের আবাসিক প্লটের প্রায় এক-চতুর্থাংশই পেয়েছেন তারা। লটারির মাধ্যমে তাদের প্রকল্পের জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০ হাজার কাঠারও বেশি। কাঠাপ্রতি ৫০ লাখ থেকে শুরু হয়ে বর্তমান বাজারদরে জমির মূল্য উঠেছে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত। 
এভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের বিত্তশালী হওয়ার পথ করে দিয়েছে পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ। যারা প্লটের বরাদ্দ পেয়েছেন, আর্থিকভাবে অভাবনীয় মাত্রায় লাভবান হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তারা। পূর্বাচলের জমি বিক্রি করে এ কর্মকর্তাদের হাতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ আসছে। সারা জীবন চাকরির পর পেনশন হিসেবে মোট যে পরিমাণ অর্থ তাদের প্রাপ্য হতো, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ তারা আয় করে নিচ্ছেন শুধু পূর্বাচলের প্লট বিক্রি করে।
প্রকল্পটিতে প্রথম পর্যায়ের লটারির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের ১ হাজার ৬৩২টি প্লট বরাদ্দ দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিজীবীদের ৬৫৪, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি কোটায় ৪৭২, বেসরকারি চাকরিজীবীদের ৫৯১, প্রবাসী কোটায় ৫৯১, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২৯৬, সচিব কোটায় ২৪, আইনজীবী কোটায় ১১০, বিচারপতি কোটায় ১৪, সংসদ সদস্য কোটায় ৫৭, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোটায় ৫৭, অন্যান্য কোটায় ১৮১, শিল্পী কোটায় ১৫১ ও সাংবাদিক কোটায় ৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া রাজউক কর্মকর্তা, সংরক্ষিত ও প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যও প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। লটারির পরও বিভিন্ন সময় পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রথম বরাদ্দের পর থেকে এ পর্যন্ত জমি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রচুর প্লটের মালিকানা বদল হয়েছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব প্লট ক্রয়মূল্যের চেয়ে ১৫-২০ গুণ দামে বিক্রিরও নজির রয়েছে। লটারিতে প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন এক সরকারি কর্মকর্তা। বরাদ্দ পাওয়া থেকে শুরু করে ইজারা দলিল হাতে পাওয়া পর্যন্ত তার ব্যয় হয়েছে ১৫ লাখ টাকার মতো। ১৭ নম্বর সেক্টরের পাঁচ কাঠা প্লটের জমিটি তিনি বছর চারেক আগে কাঠাপ্রতি ৫০ লাখ টাকা দরে মোট আড়াই কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন।


 

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন