মৃণাল বন্দ্য : কোভিড পরবর্তী সময়ে এবং বিশ্ব রাজনীতির টালমাটাল অবস্থায় ধুঁকছে সামগ্রীক অর্থনীতি। পৃথিবীর অনেক দেশ নিজেদের একটু একটু করে গুছিয়ে নিয়েছে। নিজ দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে পরিকল্পনা করছে কিভাবে খাপ খাইয়ে নেয়া যায় সামগ্রিক পরিস্থিতিতে। পাশের দেশ শ্রীলংকাও গুছিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ডলার সংকট কাটাতে একেক দেশ নিচ্ছে একেক রকম পদক্ষেপ। বৈদেশিক ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে সম্ভবত একমাত্র বাংলাদেশই আছে নিশ্চিন্তে! অবাক হচ্ছেন?
বাংলাদেশে ঠিক কতজন বিদেশী কাজ করছেন, ঠিক কতো টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে, কেন বিদেশীদের চাকরী দিতে এতো আগ্রহ আমাদের সে বিষয়ে কোন তথ্য কারও কাছে নেই! কি অদ্ভুত তাই না? ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। কেঁচো খুড়তে সাপ বের হয়ে আসছে। অপ্রয়োজনীয় জায়গায় বাংলাদেশীদের ৫ জনের বেতনে একজন বিদেশী এনে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে ডলার পাচার হচ্ছে! মূল বেতনের খুব অল্প পরিমাণ দেখানো হচ্ছে ব্যাংকে আয়কর ফাঁকি দিতে। ভূয়া কাগজ পত্রে সেটা একমাত্র এদেশেই সম্ভব।
একটা দেশে বাইরে থেকে কতোজন লোক আসছে, তারা কেন আসছে কি করছে তার ডাটা নেই কোন মন্ত্রণালয়ে। কেউ বলছেন সংখ্যাটা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, কেউ বলছেন ১০ লাখের কম নয়। কেউ কেউ তো বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে চলে যাওয়ার পরেও কোন ডাটা না থাকা একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে মোটামুটি ভাবে মোট বিদেশীদের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ আসে ভারত থেকে, ২৫ শতাংশ আসে শ্রীলঙ্কা থেকে, ১৩ শতাংশ আসে চীন থেকে, ৮ শতাংশ আসে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে, ১ দশমিক ৭ শতাংশ আসে তুরস্ক থেকে এবং ১ শতাংশ আসে পাকিস্তান থেকে। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়ার শ্রমিকরাও এখন কাজ করছেন।
প্রশ্ন আসতে পারে, কেন প্রয়োজন বিদেশীদের? আমাদের দেশে কি দক্ষ জনশক্তি নেই? আমাদের অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষন দিতে কিংবা কোন নতুন কারখানা/উদ্যোগ যেখানে ইতিপূর্বে আমাদের অভিক্ষতা নেই সেখানে আমাদের লোকদের দক্ষ করে তুলতে বিদেশীদের আনা যেতে পারে। তবে সেটাও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। আমাদের দেশে ১৫/২০ বছর রয়ে গেছেন এমন বিদেশি কম নয়। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের দেশে নতুন। আমাদের দেশের লোকদের অভিজ্ঞতা নেই। এখানে বিদেশীদের ছাড়া আমাদের উপায় নেই। কিন্তু যেই শ্রীলংকায় পোষাক শিল্প নেই দীর্ঘদিন ধরে। সেখান থেকে লোক এনে আমাদের দেশে কি শিখাতে চান মালিকরা সেটাই এক রহস্য। উনারা এখন আর প্রশিক্ষন দিতে আসেন না। আমাদের দেশের মতো তারাও আসেন স্রেফ চাকরী করতে, বরং ৫ গুণ বেশি বেতন নিয়ে। আর সেই টাকা কতোটা বৈধ পথে যাচ্ছে আর কতোটা কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে সেটা তদন্ত সাপেক্ষে বের করা যেতে পারে। হুন্ডি এখন ওপেন সিক্রেট। শুধু দেখেন না বা শোনেন না যাদের শোনার কথা।
পোষাক শিল্পে মার্কেটিং আর মার্চেন্ডাইংয়ে মালিকদের প্রথম পছন্দ বিদেশীদের। অথচ এদেশে অভিজ্ঞদের অভাব নেই। উৎপাদন কিংবা কন্সট্রাকশনেও প্রধান্য বিদেশী। অথচ আমাদের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে কিংবা বুয়েট থেকে পাস করে বেকার রয়েছেন অনেকে। বায়িং হাউজগুলোতে বিদেশী নিয়োগ একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে এখন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রক কিংবা টেকনেশিয়ানের সংখ্যাটা প্রচুর। এদেরকে কাজে লাগাতে হবে। কোন নতুন প্রযুক্তি এলে সাথে প্রযুক্তি উদ্ভাবকরা লোক পাঠিয়ে দেন প্রশিক্ষনের জন্য। তবে কেনো লাগবে বিদেশী নামের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া লোকেদের? এরা কাড়ি কাড়ি ডলার নিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের রিজার্ভ শূণ্য করে, সাথে বাড়াচ্ছে বেকারত্ব।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকা বেপজাতেও এই সংখ্যাটা কম নয়। এখানে কিভাবে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এতো বিদেশী লোক কাজ করে, কারা এদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন তার তদন্ত জরুরী। দেশের প্রয়োজনেই রিজার্ভের পতন ঠেকাতে এটিও হতে পারে কার্যকর একটি উপায়। নইলে লাভের গুড় যে পিঁপড়া খাবে!
সাম্প্রতিক হিসেবে প্রায় ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে ১৭৬ টি দেশে। যাদের পাঠানো ডলারে ফুলে ফেঁপে উঠে আমাদের রিজার্ভ। অথচ সবচেয়ে অবহেলিত এই প্রবাসী শ্রমিকরা। গত কিছুদিন ধরে সংবাদ শিরোনামে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা সর্বস্ব হারানো শ্রমিকদের কান্নার ছবি! কারও কাছে সঠিক হিসেব নেই এর সংখ্যাটার। কারও কাছে ১৭ হাজার আর কারো কাছে ৪ কিংবা ৫ হাজার! ৭৯ হাজার টাকার চুক্তি গিয়ে দাঁড়ায় ৫-৭ লাখ টাকায়! প্রবাসী মন্ত্রীর নিরুত্তাপ জবাব আর প্রধানমন্ত্রীর তদন্তের আশ্বাসে আমাদের চুপ থাকতে হয়। আর প্রবাসীদের পাঠানো ডলার কিংবা আমাদের দেশের লাখো পোষাক শ্রমিকদের ঘামে ভেজা ডলার চলে যাচ্ছে নাম সর্বস্ব বিদেশীদের হাতে!
mrinalbanday@gmail.com
প্রভাত/আসো