মৃণাল বন্দ্য : খুব চমকে উঠার মতো ব্যাপারই বটে! আলোচিত এক হত্যা মামলার আসামি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা গোলাম রসুল ওরফে নিশান বুধবার চট্টগ্রাম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে আসেন ৫০ থেকে ৬০ জন সহযোগী ও অনুসারী নিয়ে। এ সময় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের ছবি তুলতে বাধা দেন। শুধু তাই নয়, গোলাম রসুলের সঙ্গে থাকা তাঁর এক অনুসারী ছবি তুলতে গেলে একজন জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্র সাংবাদিকে বাধা দেন। অশালীন ভাষায় গালাগালের পাশাপাশি তাঁকে হত্যারও হুমকি দেন।
এগুলো কিন্তু নির্জন কোন জায়গায় কিংবা রাস্তায় হয়নি। হয়েছে খোদ আদালত প্রাঙ্গণে। যেখানে অন্য যে কোন জায়গার চেয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাং এতোটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে যে সাধারণ মানুষ আতংকিত হয়ে পড়েছে। এরা কোন কিছুকেই কিছু মনে করে না। বয়সের অজুহাতে বড় কোন সাজা হয় না, যেহেতু বলা হয় ১৫-১৭ বছরের মধ্যেই এদের সদস্য বেশি। আবার এমন অভিযোগও আছে, ১৮-২০ বছরের তরুণরাও এই সুযোগ নিচ্ছে। অপরাধে জড়িত কিশোরদের নেওয়া হচ্ছে সংশোধনাগারে এবং প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কঠিন আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। সাধারণত তারা মাদক চোরাচালান, ইভটিজিং, সন্ত্রাসী, গ্যাং তৈরি করে চলাফেরা করা, জমি দখল করার জন্য ভাড়ায় খাটা, হামলা, খুন, রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে গিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করা, ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা, টাকার বিনিময়ে সামাজিক অপকর্মে জড়ানোসহ ইত্যাদি সামাজিক অপরাধে জড়িত থাকে।
এরা হিন্দি ফিল্মি স্টাইলে চলাফেরা করে, নিজেকে ভাবতে শুরু করে ছবির নায়ক। সিনেমার স্টাইলেই এরা কেড়ে নিচ্ছে পথচারীদের টাকা, মোবাইল। পাড়া মহল্লায় ফ্রিতে হোটেল রেস্তোরায় খাচ্ছে, মাদক নিচ্ছে অবাধে। রাস্তায় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। বাধা দিতে গেলেই পুরো গ্রুপ মিলে তেড়ে আসে তার উপর। যেমনি ভাবে চট্টগ্রামে ছেলেকে বাচাতে গিয়ে জনসম্মুখে কিশোর গ্যাং এর পিটুনিতে খুন হন বাবা। যিনি ছিলেন একজন দন্ত চিকিৎসক। আশেপাশের সবাই চুপ থাকলেও বাবা আর ভাইরা চুপ থাকতে পারেন না তাদের সন্তান কিংবা বোনকে বাঁচাতে। এগুলো কিন্তু কোনটাই নতুন কোন ঘটনা নয়। দিনের পর দিন চলছে। কেউ কথা বলে না এদের বিরুদ্ধে। যে স্থানীয় প্রতিনিধিরা বলবেন, তারাই এদের পৃষ্ঠপোষক! এই বড় ভাইদের জোরেই কিশোর গ্যাং নামক নষ্ট বখে যাওয়া কিশোররা একটা অরাজক পরিবেশ তৈরি করছে চারপাশে। থানায় এদের নামে কেউ মামলা করতে যায় না। কারণ ফিরে আসার সময় নিশ্চয়তা নেই তার নিজের, তার বোন, স্ত্রী কিংবা সন্তানের। কি ভয়াবহ ব্যাপার! পুলিশ বাহিনীও উপর মহলের গ্রীন সিগনালের অপেক্ষায় থাকেন। যেগুলো তারা কখনই পান না।
সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের প্রতিনিধিত্বেই তারা অপরাধে জড়াতে উৎসাহিত হয়। যে কারণে অপরাধীরা কারাগারে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে বের হয়ে আবার অপরাধ করতে থাকে। তাদের মধ্যে অপরাধে জড়িত হওয়ার পরও ন্যূনতম কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না। তারা দ্বিধা করে না জেলে যাওয়া নিয়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংশ্লিষ্টতা থাকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পড়েও তারা খুব সহজেই জামিনে বের হয়ে আসছে। পারিবারিক শিক্ষার অভাব, দুর্বল আইনি ব্যবস্থা, সামাজিক বিপর্যয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়, জনপ্রতিনিধিদের অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া, প্রযুক্তির অপব্যবহার, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব, মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে কিশোরেরা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করা—দেশের যেকোনো এলাকায় এখন এ ধরনের অপরাধ ঘটলে কিছুদিন আগেও পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক অপরাধের ঘটনায় নাম আসত কোনো না কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর। এখন সে জায়গা ‘দখল’ করেছে কথিত কিশোর গ্যাং। এখন সারা দেশে ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি।
মুক্তির উপায় কি? প্রধান উপায় হচ্ছে পারিবারিক শিক্ষার উপর জোর দেয়া। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে সেটা যেমন খেয়াল রাখা, একই ভাবে পাড়া মহল্লায় সম্মিলিতভাবে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নইলে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়বে খুব দ্রুত। ইতোমধ্যে আমরা দেরি করে ফেলেছি। যে সব জনপ্রতিনিধি এদের প্রশ্রয় দেন, এদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন, সময় এসেছে এসব জনপ্রতিনিধিদেরও বয়কট করার।
mrinalbanday@gmail.com
প্রভাত/আসো