মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ীÑ ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে দেশের ৭ জেলায় ৭টি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলাগুলোয় দেখা দিয়েছে বন্যা। গত ৩০ মের পর থেকে সিলেট বিভাগে ৩ দফা বন্যার ফলে জনদুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। দ্বিতীয় দফার বন্যার পানি নেমে যাওয়া বিস্তীর্ণ এলাকা আবারো নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সেসব এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ঘরে ফেরা মানুষ আবারও আশ্রয় কেন্দ্রমুখী হচ্ছে। তিস্তার পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের নি¤œাঞ্চল। নীলফামারী জেলার বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকায় ডুবে গেছে বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। চেঙ্গী ও মাইনী নদীর পানি বেড়ে তীরবর্তী ও কয়েকটি নিঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাহাড় ধসে ও বন্যার পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। বন্যায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ির জিনিসপত্র ও আবাদি ফসল নষ্ট হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনীসহ বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের চরম জনদুর্ভোগ সহজেই অনুমেয়। মানুষ বন্যার পানিতে আটকা পড়েছে অথবা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই নিচ্ছে। এখন যা দরকার, তা হলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে শুকনা খাদ্য, নিরাপদ পানি ও অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছানো যায়।
ত্রাণ ও চিকিৎসা দলগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় পাঠানো প্রয়োজন। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এ সময় বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার, আশ্রয় স্থান ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সংকট তীব্র হয়। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, বাড়িতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত। এ মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হলো ত্রাণ ও ওষুধ সরবরাহ এবং বন্যাকবলিত এলাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করা। যেসব এলাকায় দোকান ও গুদাম পানিতে তলিয়ে গেছে সেখানে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। সেখানে খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া যাদের আবাদি ফসল নষ্ট হয়েছে তাদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে আবাদ করতে পারে।
বুধবার আবহাওয়া বিভাগের তথ্যানুসারে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চার-পাঁচদিন ধরে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এ সপ্তাহজুড়ে তা অব্যাহত থাকবে। পরে ধীরে ধীরে বৃষ্টি কমে আসবে। এ সপ্তাহজুড়ে যেহেতু বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে, সেজন্য পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে। সেজন্য আগাম জোরালো প্রস্তুতি নেয়া দরকার। প্রয়োজনে প্রশাসনের পাশাপাশি সব ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীকে উদ্ধারকাজে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে হবে। এ মুহূর্তে প্রধান করণীয় হলো বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া। যেখানে সড়ক ও নৌযোগাযোগ বন্ধ আছে সেখানে হেলিকপ্টারে করে মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। এরপর প্রত্যেকের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। বিশেষ করে যাদের ঘরবাড়ি ও কৃষি, মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ঘর মেরামত করতে হবে তাকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। যার কৃষি উপকরণ দরকার তাকে উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই। আশা করি, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা সমন্বিতভাবে কাজটি করবেন।
বর্তমানে উদ্ধার কর্মসূচির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রীও দ্রুত পৌঁছাতে হবে বন্যা উপদ্রুত এলাকায়। যেসব স্থানে রান্নার সুযোগ থাকবে না, সেসব স্থানে শুকনা খাবার সরবরাহ করতে হবে। কেন্দ্রগুলোয় যাতে রোগ ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে। দুর্গত এলাকায় খাদ্য ও ওষুধ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বাগ্রে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদেরও। দেশে বহু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আছে, তাদেরও এ ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সরকারিভাবে অনেক এলাকায় ত্রাণসহায়তা দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এসব মানুষের কাছে অতিদ্রুত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র এবং নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। গৃহপালিত পশু-পাখি নিরাপদে সরিয়ে আনতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও দেশের সামর্থ্যবানদের বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।
বন্যাকবলিত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের লক্ষণ এখনো দেখা না গেলেও অচিরেই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সামনে ভয়াবহ বন্যার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা আমলে নিয়েই এখন থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেয়া উচিত সরকারের। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো আমাদের আয়ত্তের বাইরে। তবে যথাযথ প্রস্তুতি নিলে মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যসহায়তার সংস্থানে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশুদ্ধ পানি, পর্যাপ্ত ওষুধপত্র ও নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। সরকার ও প্রশাসন এই বিষয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
প্রভাত/টুর