শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১
Proval Logo
গণতন্ত্র কাঁদছে নিভৃতে 

জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত প্রভাবশালীদের ইশারায়

প্রকাশিত - ০২ জুন, ২০২৪   ১০:৫২ পিএম
webnews24

মৃণাল বন্দ্য : চারপাশে নতুন নতুন খবরের কমতি নেই!  সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের বিরুদ্ধে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদের বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অবৈধ অর্থ সম্পদের অভিযোগ, উনি দেশে আছেন কি নাই তা নিয়ে প্রধান শিরোনাম। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়ে এমপি আনার খুন, ফেসবুক এমপি বলে পরিচিত সুমনের সংসদ গরম করা খবর- কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়বেন বা জানবেন? সবই টুইস্টে ভরা।

একেক নিউজ চ্যানেল কিংবা সংবাদপত্র একটার পর একটা গরম গরম আপডেট (যাকে আমরা এখন ব্রেকিং নিউজ বলি) দিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে বিশ্বকাপের ঠিক আগে আমেরিকার কাছে সিরিজ হেরে বসেছে বাংলাদেশ দল। ১১ জনের দলে কাকে নেয়া যেতো, কেনো লিটন-সৌম্যকে নেয়া হলো- কতো কতো খবরের শিরোনাম। টক শোতে কোন বিষয় রেখে কোনটাকে প্রাধান্য দিবে সেটাও এখন ঘাম ঝড়ানোর মতো ব্যাপার। আর ভারতের নির্বাচনে ওই দেশের মানুষ কিংবা সাংবাদিকের আগ্রহের চেয়ে আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহ বেশি। সাথে ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের সাথে পর্ণ তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের খবর কে কতো বেশি রসিয়ে রসিয়ে লিখতে পারছে তাতেও চলছে প্রতিযোগিতা।

মজার ব্যাপার হলো এর মাঝেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রতিযোগিতামূলক উপজেলা নির্বাচন। ঝড়ের কারণে কিছু জায়গা বাদে তৃতীয় দফার নির্বাচনও শেষ। যাতে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় এমনিতেই আগ্রহ হারিয়েছে। যদিও বিএনপির কিছু নেতা দলের বিপক্ষে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দল থেকে বহিস্কার হয়েছেন। তাতে তেমন কিছু যায় আসেনি। পাদপ্রদীপের আলোয় আসেনি এই নির্বাচন। বেশিরভাগ জায়গায় জিতেছে সরকার দলীয় সমর্থক প্রার্থী। আর বিএনপি ব্যস্ত থাকছে গণদোয়ার মতো কর্মসূচি নিয়ে। এরচেয়েও বড় কথা স্থানীয় এমপি অর্থাৎ স্থানীয় প্রভাবশালীদের পরিবারের সদস্য কিংবা আস্থাভাজনরাই জিতেছেন বেশিরভাগ স্থানে। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশও উপেক্ষিত হয়েছে কিছু জায়গায়। আরও বড় আশাহত হবার মতো খবর হলো কিছু কিছু জায়গায় মাত্র ১০ ভাগেরও নিচে ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন অনেকে। ভীষণ উদ্বেগজনক খবর।

একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন সংস্কৃতিতে বড় আঘাত এটি। যদিও সাংবিধানিক ভাবে এটি বৈধ, তবে দেশের জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে এগিয়ে না আসায় ক্ষতিগ্রস্থ হলো সামগ্রিক গণতান্ত্রিক কাঠামো। বলা যায় প্রশ্নবিদ্ধ হলো। ভোটারবিহীন এই নির্বাচন নিয়ে বড় এক প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করায় বৈকি! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার ভোটারদের অনাগ্রহের বিষয়ে খুব একটা চিন্তিত কিংবা গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয়নি। আর অনেক বড় বড় খবরের চাপে এটি পিছনেই পড়ে গেছে। একে সরকারের একটা রাজনৈতিক কৌশলও বলা যেতে পারে।  
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এবারের উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে যাঁরা ১০ শতাংশের কম সমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের একজন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের মো. মোস্তফা মহসিন। ইসি সূত্র জানায়, এই উপজেলায় মোট ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৭৯ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৫৫৭ জন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা মহসিন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ২৭ হাজার ১১৯ ভোট পেয়ে। অর্থাৎ তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের মাত্র ৬ দশমিক ৮০ শতাংশের ভোট পেয়েছেন! 

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের উপজেলা নির্বাচনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৮০ হাজার ১১১। এর মধ্যে ৩৬ হাজার ৬৭৭ জনের ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন শাহেদ শাহরিয়ার। তিনি পেয়েছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশের ভোট। সাতক্ষীরা সদরে ভোট পড়েছে ২৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এখানে ৩১ হাজার ১৯৬ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন মশিউর রহমান। তাঁর উপজেলায় মোট ভোটার ছিলেন ৪ লাখ ৬ হাজার ১৬৩ জন। সে হিসাবে তিনি পেয়েছেন মোট ভোটারের ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশের ভোট। এ ছাড়া বগুড়া সদরের শুভাশিস পোদ্দার, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ, সিলেটের বিয়ানীবাজারের আবুল কাশেম ও টাঙ্গাইল সদরের তোফাজ্জল হোসেন ১০ শতাংশের কম জনসমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

তৃতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম জনসমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। তাঁদের মধ্যে সাতজন জয়ী হয়েছেন ১০ শতাংশের কম জনসমর্থন পেয়ে। এই ধাপে গত বুধবার ৮৭টি উপজেলায় ভোট হয়। নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায়এবার বেশির ভাগ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন খুব কম ভোট পেয়ে। এর আগে দ্বিতীয় ধাপের ১৫৬টি উপজেলার মধ্যে ৮৯টিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তাঁদের নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে। অবশ্য প্রদত্ত ভোটের হিসাবে তাঁদের ভোটের হার আরও বেশি।

এবার চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বুধবার তৃতীয় ধাপের ভোট হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সব উপজেলার ফলাফল সমন্বয় করে। তাতে দেখা যায়, তৃতীয় ধাপে ভোট পড়ার হার ৩৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর আগে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। এই ভোটের হার গত দেড় দশকের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে সর্বনিম্ন। আরও একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে এবারে উপজেলা নির্বাচনে প্রায় ৭০ শতাংশ প্রার্থী ব্যবসায়ী আর কোটিপতির তো অভাব নেই। তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রায় ৬৭ শতাংশই ব্যবসায়ী। কোটিপতি প্রার্থী রয়েছেন ১০৬ জন। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ৯০ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১১ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫ জন কোটিপতি। টিআইবি বলেছে, প্রার্থীদের হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে কোটিপতির হিসাব করা হয়েছে। ভূমির মতো স্থাবর সম্পদের মূল্য নির্ধারণ কঠিন হওয়ায় তা কোটিপতির হিসাবে আনা হয়নি।

টিআইবির বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৬৬ দশমিক ৫৩ শতাংশই নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন কৃষিকাজ। পেশার ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন আইন পেশা ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও শিক্ষকতা ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদেরও ৬৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ নিজেদের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ গৃহিণী। গৃহস্থালির কাজকে তাঁরা পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের প্রায় ৩২ শতাংশ পেশায় ব্যবসায়ী। ২১ মে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ৭১ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি ছিলেন ১০৫ জন। এর আগে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ী কিংবা কোটিপতিদের নির্বাচনে আসতে বাধা নেই, যদি উনারা আসেন সেবার উদ্দেশ্য নিয়ে। মুনাফা করার উদ্দেশ্যে আসছেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। টিআইবির পর্যবেক্ষণে জনপ্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় থাকলে অনেকের আয় ও সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ফলে জনস্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট বাড়ছে। অন্যদিকে কৃষিজীবী ও শিক্ষকতায় যুক্ত প্রার্থীদের সংখ্যা কমছে। যেটা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উদ্বেগজনক! 

mrinalbanday@gmail.com
প্রভাত/আসো

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন
তৃতীয় মেরু