সম্পাদকীয়
দেশে বেকারত্ব কমাতে হলে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পুরোপুরি চালু করতে হবে। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে হবে, যাতে কর্মবাজারে তাঁদের চাহিদা থাকে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির চেয়ে কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে, এত দিন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যেসব সুবিধা পেয়েছি, সেটা কমে যাবে। অন্তর্র্বতী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছে। তারা বেকারত্ব নিরসন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দেবে আশা করি।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৮। এ থেকেই দেশের বেকারত্বের মাত্রা ধারণা করা যায়। দেশে শোভন কাজ না পেয়ে ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় অনেক বাংলাদেশি তরুণ ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করছেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বিদেশের কারাগারে বন্দী বাংলাদেশির সংখ্যাও কয়েক লাখ।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে যুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে দেশীয় বাজারে খুব বেশি হলে ১২ থেকে ১৩ লাখের কর্মসংস্থান হয়। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় ন্যূনতম মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে, বাকিরা শোভন চাকরিতে যান। আর প্রতিবছর ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ প্রবাসে যান। বাকিদের কাজের কোনো সুযোগ নেই।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে কাজের প্রত্যাশায় গড়ে প্রতি ঘণ্টায় দেড় শ বাংলাদেশি দেশ ছাড়ছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশিদের জন্য যত নতুন কর্মসংস্থান হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে প্রবাসে। স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
বাংলাদেশে বেকারত্ব যে কত প্রকট রূপ নিয়েছে, তা জানার জন্য গবেষণার প্রয়োজন হয় না। জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে বিদেশ গমন ইচ্ছুক তরুণদের ভিড় দেখলেই ধারণা করা যায়। দেশে চাকরির ব্যবস্থা থাকলে বিদেশে যাওয়ার জন্য তরুণেরা এভাবে হন্যে হয়ে উঠতেন না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জুন মাসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছে, দেশে এক বছরে বেকার বেড়েছে দেড় লাখ।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণায় বলেছে চাকরির সিংহভাগই তৈরি হয় বেসরকারি খাতে। কিন্তু শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ধরনের ব্যর্থতা আছে।
বেকারত্বের কারণ যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বড় বড় প্রকল্প হয়েছে, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় বেসরকারি খাতের প্রসার তেমন ঘটেনি। শিল্পকারখানার জন্য যে অপরিহার্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তার সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। সরকার ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বললেও বেশির ভাগের কাজই শুরু হয়নি। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এতটাই সেকেলে যে যুগের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এ কারণে আমরা বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কর্মী আনি আর আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা বেকার থাকেন।
বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ এর গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল প্রতিবেদন অনুসারে, প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ-তরুণী শিক্ষা-কর্ম বা প্রশিক্ষণে নেই। পুরুষদের মধ্যে এ হার প্রায় ১৯ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে এ হার প্রায় ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক তরুণ ও তরুণী বেকার বা ছদ্মবেকার জীবন যাপন করছেন।
দেশে সততা ও নৈতিকতা জাগ্রত করা খুবই দরকার
দেশের সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিকে ভীষণভাবে নড়বড়ে করে দিয়েছে নানা ধরনের দুর্নীতিবাজরা। ঘুষ-দুর্নীতির কোন রাখঢাক ছিল না, ছিল না কোনো ঘৃণা বা ধিক্কার। তাই ঘুষের চাষাবাদ বাম্পার ঘুষফল উৎপাদনের টার্গেট পূরণ করেছে! এখন এর পরিসমাপ্তি ঘটানো দরকার। কোন সেক্টর ঘুষবিহীন কাজ করে? শিক্ষা সেক্টরকে পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। সাধারণত: সেখানে দুর্নীতি করার উপায় নেই। কিন্তু এই সেক্টরে গ্রামের একজন নিরীহ স্কুলশিক্ষক জায়গামতো ঘুষ না দিলে পেনশনের টাকা পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? সারা জীবন সৎ থেকে একজন ভুক্তভোগী বৃদ্ধ শিক্ষকের আঁকুতি- বাবারে, আমি কয়দিন বাঁচবো? আমাকে হেড অফিসে ঘুষ দিয়ে পেনশন পাস করাতে বলো না। না খেয়ে মরবো, তবু জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে চাই না।
নিত্যপণ্যের বাজারে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় স্ফীতি ও অভাবের সাথে সামঞ্জস্যবিধান করতে না পেরে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘুষ পোকার পঙ্গপাল চরিত্রের গ্রাসে আক্রান্ত হয়ে চরমভাবে হতাশাগ্রস্থ হয়েছে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন। নতুন সরকার তথা অন্তর্র্বতী সরকারের এই জ্বলন্ত ইস্যুর দিকে নজর দেয়ার সময় হলে দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে। তাঁর মতো মহান শিক্ষকের এত পবিত্র উপলব্ধি তো আমাদের সমাজে সবার নেই। আমাদের আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঘুস লেনদেনের প্রতি এতটাই বেপরোয়াভাবে আকর্ষিত হয়ে পড়েছে যে তার থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন। এক শ্রেণির মানুষ পেটের দায়ে বাঁচার জন্য চুরি, ছ্যাঁচড়ামি করে অর্থ আয় করে তাদের কথা আলাদা। কারণ সমাজে এদের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু পদধারী, ক্ষমতাধারী লোভী মানুষেরা যখন চুরি, জালিয়াতি, মিথ্যাপনা, দখলবাজি, ছলনা ইত্যাদির মাধ্যমে ঘুসের জাল বিস্তার করে চাকুরি, পদোন্নতি, বদলী, ছুটি, পেনশন প্রত্যাশী নিরীহ অথবা বেকার মানুষকে সহজে ফাঁদে ফেলে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করে এটাই ঘুস। এটাই দুর্নীতির মহামারি। যে কোনো পদে নিয়োগদান থেকে শুরু করা যাক। ভোট থেকে শুরু করতে পারলে ভাল হতো। যে কোনো পর্যায়ে নির্বাচনের সময় আমাদের দেশে মতো এতো হৈ-চৈ, মারামারি, খুন-খারাবি, ভোট চুরি, জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদির অভিযোগ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটে বলে মনে হয় না। এই প্রবন্ধে এসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না। শুধু সরকারী চাকুরিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগদান থেকে শুরু করি।
ঘুষের ঘুণপোকারা ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের মতো চারদিকে গ্রাস করে অস্থির করে তুলেছে জনজীবন। হরণ করে ফেলেছে নিরীহ শান্তিকামী মানুষের ঘুম, সুখ-শান্তি সবকিছু। নিত্যপণ্যের বাজারে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় স্ফীতি ও অভাবের সাথে সামঞ্জস্যবিধান করতে না পেরে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘুস পোকার পঙ্গপাল চরিত্রের গ্রাসে আক্রান্ত হয়ে চরমভাবে হতাশাগ্রস্থ হয়েছে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন। নতুন সরকার তথা অন্তর্র্বতী সরকারের এই জ্বলন্ত ইস্যুর দিকে নজর দেয়ার সময় হলে দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। আর এসব ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিও করছেন। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন প্রশ্নফাঁস-কান্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর তারাও আতঙ্কে রয়েছেন। গত ৩০টি পাবলিক চাকুরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করা হয়েছে।
দেশে ৪০ ভাগেরও বেশি শিক্ষিত বেকারত্ব, চাকুরির বাজারে আকাল, ঘুষ ছাড়া নিয়োগ নেই, ইত্যাদির কথা কে কাকে শোনাবে আর কে শুনবে? তাদের দাবি বা আহাজারী শুনে কর্তৃপক্ষের কারো কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত নেই। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি শোনার মতো কেউ নেই। শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিকে জোর করে অযৌক্তিক বলে অমর্যাদা করতে কেউ কেউ দ্বিধা করে না। কারণ, কারো প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যৌক্তিক পথে তারা দায়িত্বে বসেনি। যারা তাদেরকে দায়িত্বে বসার সুযোগ করে দিয়েছিল তাদেরকে তারা অবাধ দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়ে সুতোয় টান মেরে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। এমন একটি নাজুক আর্থ-সামাজিক ও কর্কশ পরিস্থিতিতে ভালকথা বা নীতিকথা কারো কর্ণকুহরে প্রবেশ করানো কঠিন।
ফলে দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে। পোষা বিড়ালকে মাথায় তুলে আদর করায় তারা বেপরোয়া হয়ে দুর্নীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাছ খেতে দিয়ে হঠাৎ কেড়ে নিতে চাইলে বিড়াল গোস্বা করে পাতে কামড় বসাতেই পারে। মাথায় উঠায় তারা আর ইঁদুর ধরে না। বরং নিজেরাই ইঁদুরের সাখে খেলা করে, ভোজ করে। রক্ষকরাই এখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
ঘুণপোকারা পিএসসিতে কবে থেকে সক্রিয় সে খবর কি কেউ জানেন? এই চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানটিকে কুঁরে কুঁড়ে খেয়ে কারা জর্জরে করে ফেলেছে তাদেরকে কি চিহ্নিত করা হবে? গত এক যুগে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে ভয়ংকর ঘুণপোকা তৈরি হয়ে চারদিকে ছারখার করে তুলেছে। তারা আজ কে কোথায় চাকুরি করছেন সেটা খুঁজে বের করবে কোন বিড়াল, কোন থাবা নিয়ে?