মৃণাল বন্দ্য : উপমহাদেশের সরকার ব্যবস্থাই এমন হয়ে দাড়িয়েছে, যখন যে সরকার প্রশাসন তার নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। টানা ৪ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে সেটা আরও প্রকট হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ একটু বেশি সুবিধা পেয়ে যান বৈকি। তবে সাবেক র্যা ব প্রধান ও সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ সম্ভবত সব ছাড়িয়ে গেছেন। ইতিপূর্বে তার মতো করে এতো বিশাল অংকের কোন দুর্নীতি কোন পুলিশ কর্মকর্তা করেছেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর আইজিপি ছিলেন বেনজির আহমেদ। রাজনৈতিক নেতার মতো তার কন্ঠেও শোনা গেছে শুদ্ধতার মন্ত্র। কোন দুর্নীতিবাজকে ছাড় দেয়া হবে না বলে উনি যখন গরম গরম বক্তব্য দিচ্ছিলেন, পেছনের দরজা দিয়ে ঠিক তখনই দখল করে নিচ্ছিলেন মানুষের ভিটে মাটি, এক রত্তি আবাস!
মজার ব্যাপার হলো উনি যে এলাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই ভূমি দস্যুতা করেছেন সেটি স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জ। যে এলাকা থেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই এলাকায় দিনের পরে দিন মানুষ ভিটে মাটি ছাড়া হচ্ছে, সেটা উনি জানেন না এটা কিভাবে হতে পারে? সারা বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদন আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখান থেকে কে এবং কেনো প্রধানমন্ত্রীকে জানালো না সেটাও তদন্তের বিষয়।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জের হিন্দুদের ‘শত শত বিঘা’ জমি দখলের অভিযোগ এনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ওই এলাকা ঘুরে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কৃষির ওপর নির্ভরশীল ওই এলাকার মানুষদের জমি দখল করে ফেলায় তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে বিশাল অর্থনৈতিক সংকট নেমে এসেছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে র্যাবের মহাপরিচালক এবং ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আইজিপি থাকার সময়ে বেনজীর আহমেদ গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৈরাগীটোল গ্রামে ৬২১ বিঘা (দুদকের তথ্য অনুযায়ী) জমির ওপর গড়ে তোলেন সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক। এ রিসোর্ট ও পার্কের সব জমি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। তাঁদের ভাষ্য, ভয় দেখিয়ে, জোর করে ও নানা কৌশলে জমি কেনা হলেও অনেক জমি দখল করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করে। পরে সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কসহ বিভিন্ন স্থাপনা জব্দের নির্দেশ দেন আদালত। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে বক্তব্য দিচ্ছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। উনি বলছেন- বেনজীর ও আজিজ যা করেছেন, সেটা ওনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে রাষ্ট্রের কোনো বিষয় না।‘ কি দারুণভাবে তিনি এড়িয়ে গেলেন। এ বিষয়গুলোকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে চেপে রাখার কোনো সুযোগ নেই। এতোগুলো হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ করে তিনি কিভাবে এতো জমি আর সম্পদের মালিক হলেন সেই জবাব তার কাছ থেকেও নেয়া উচিত। কারণ ওবায়দুল কাদের সরকার এবং আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজির আজমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির প্রায় সবই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাঁরা বলছেন, জমি বিক্রি ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় ছিল না। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে তাঁদের কাছ থেকে জমিগুলো কেনা হয়েছে।
গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে গিয়ে জমি বিক্রি করা হিন্দু পরিবারগুলোর তাদের জমি কিনতে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়োজিত রেখেছিলেন বেনজীর আহমেদ। বেনজীর পরিবারের রিসোর্টের নির্মাণকাজের তদারক করতেন পুলিশ ও র্যাবের কিছু সদস্য। তাঁদের দিয়ে তরমুজ চাষসহ কৃষিকাজও করানো হয়েছে। কি দারুণ ব্যাপার! জনগণের ট্যাক্সের টাকার কি নিদারুণ অপচয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে এখন পর্যন্ত ৬২১ বিঘা জমির খোঁজ পাওয়া গেছে, যার ৫৯৮ বিঘা গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ও মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। উপজেলা দুটি পাশাপাশি। আর বেনজীর পরিবারের জমিও দুই উপজেলার সীমান্তঘেঁষা এলাকায়। ওই এলাকার গ্রামগুলো হিন্দু অধ্যুষিত। পরিবারগুলোর জমি বিক্রি করতে চাননি, বাধ্য করা হয়েছে। তাঁদের ভয় দেখিয়েছেন ।
জমি বিক্রেতারা যাঁরা বিক্রি করতে রাজি হতেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে আরেক কৌশল নিতেন বেনজীরের লোকেরা। সেটি হলো ওই জমির আশপাশের জমি কিনে নিয়ে সেখানে যেতে বাধা দেওয়া। এর ফলে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতেন সাধারণ মানুষেরা। কোনো কোনো হিন্দু পরিবারের জমির সবটুকুই বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের অভিযোগ, বহু বছর ধরে সারা দেশেই হিন্দুদের জমি দখল করা হচ্ছে অথবা জোর করে কিনে নেওয়া হচ্ছে। বেনজীর আহমেদের ঘটনাটি নতুন একটি উদাহরণ। হুমকি, হয়রানি ও হামলা—এই তিনটি পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুদের জমি নিয়ে নেওয়া হয়। জমি বিক্রেতারা বলছেন, জমি দলিল দেওয়ার সময় তাঁরা কেউই বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের দেখেননি। কাউকে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে, কাউকে রিসোর্টে নিয়ে জমির দলিলে সই নেওয়া হয়েছে।
যৌথ মালিকানার জমির মালিকদের কাউকে কাউকে মৃত দেখিয়েও জমি কেনার ঘটনা পাওয়া গেছে। অনেক ভুয়া লোককে জমির মালিক বানিয়ে জমি কিনে নেয়া হয়েছে। হিন্দু জমি দখলে বেনজির শুধুমাত্র একটি ঘটনা মাতে। আর পরিমাণ বেশি হওয়ায় আলোচনায়। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে ছোট ছোট করে যেভাবে হিন্দুদের ভিটে মাটিহীন করে ফেলা হচ্ছে তাতে আগামীদিনে হিন্দুদের সংখ্যাটা এদেশে কমবে বৈ বাড়বে না। সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে অগ্রণী ভূমিকা।
প্রভাত/আসো