প্রভাত ডেস্ক : দেশব্যাপী কোটা বিরোধী আন্দোলনের ফলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রয়াত ড. আকবর আলি খান ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫৭ ধরনের কোটা আছে, যা বিশ্বের ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। আর সেই কারণেই বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি নিয়েি বগত ৪ দশক ধরেই আপত্তি উঠে আসছে। জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন সদস্য বাদে সবাই সরকারি নিয়োগে কোটা পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। কোটার পক্ষে অবস্থান নেয়া এম এম জামান প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। এরই ধারবাহিকতায় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা আবারও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এর আগেও সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল চেয়ে ২০১৮ সালেও দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ওই বিক্ষোভের মুখে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকার পরিপত্র জারি করে। সেই পরিপত্র গত ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট বিভাগ। হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর বুধবার ৪ সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন আপিল বিভাগ। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ৯ম থেকে ১৩ তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবশ্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কোটা বহাল ছিল এবং এখনো আছে।
সরকারি তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়। এই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে রয়েছে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা। পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এই কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনিরাও যুক্ত করা হন।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোটার বিপুল পদ শূন্য থাকত। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩ তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ ৭জন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল এবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। রিট আবেদনকারী পক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন আপিল বিভাগ নট টুডে (৪ জুলাই নয়) বলে আদেশ দেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়। এই অবস্থায় কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ২ শিক্ষার্থী মঙ্গলবার আবেদন করেন।
কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ২ শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষে করা আবেদন শুনানির জন্য বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় সময় নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। পরে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর ৪ সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের পর আইনজীবীদের ভাষ্য, সব কোটা, নাকি শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরছে, তা হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে বলা যাবে। ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর {(ইডি/আরআই/আর-৭৩/৭২-১০৯(৫০০)} তৎকালীন সংস্থাপন বিভাগের সচিব এম এম জামানের স্বাক্ষরে স্বাধীনতার পর দেশের সব অঞ্চলের জনগণকে সরকারি চাকরিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি এবং সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে চাকরিতে নিয়োগের আদেশ জারি করা হয়। আদেশের শুরুতেই বলা হয়, সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে জেলাভিত্তিক এই কোটা নির্ধারণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ওই আদেশেই মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের অবদান ও ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে তাদের জনজীবনে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৩০ শতাংশ কোটা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। তেমনিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নারীদের জন্যও ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে নিয়োগের বিধান রাখা হয়।
উপসংহারে বলতে হচ্ছে যে, সময়ের প্রেক্ষিতেই পূর্বকার গৃহীত অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, বর্জন এবং নতুন করে সংশোধন করতে হয়। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। ৩ বছর আগে আমরা উদযাপন করেছি স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল সুবর্ণজয়ন্তী। তাই বর্তমানে বলবৎ কোটা পদ্ধতি বাতিল বা বর্ধিতকরণ নয় বরং যৌক্তিকভাবে সংস্কার কর এখন সময়ের দাবী। কারণ প্রকৃত মেধাবীরা দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে বাংলাদেশ একদিকে যেমন উন্নত রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাবে তেমনই দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুগপৎ ভুমিকা রাখতে পারবে। অন্যথায় দেশে সঠিক মেধার মূল্যায়ন না হওয়ায় আগামীর প্রজন্ম একদিকে যেমন শিক্ষাবিমুখ হবে অন্যদিকে দেশের আমলা ব্যবস্থাও দেশ পরিচালনায় দুর্বল হয়ে পড়বে; যা কখনোই একটি স্বাধীন ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য কাম্য নয়। সুতারাং সরকারের সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংস্কার দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বলাই বাহুল্য যে, বিদ্যমান বিভিন্ন কোটায় সুযোগ পেতে হলেও প্রত্যেক চাকুরিপ্রার্থীকে সাধারণ পরীক্ষার্থী হিসেবেই সবকটি ধাপ অতিক্রম করে আসতে হয়। সবশেষে ভাইবার সম্মুখীন হওয়ার সময় শুধু কোটা বিবেচনায় নেয়া হয়। অবশ্য সেক্ষেত্রে প্রতিযোগীতামূলক চাপটা কমে আসেÑ সুবিধা সেটুকুই। যা হোক, তার পরও সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা একেবারে বাতিল না করে তা সংস্কার করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই এই বিষয়ে সুরাহা করা দরকার বলেই আমরা মনে করি। এটাও ঠিক, চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সরকার বা কোনো দলের বিরুদ্ধে নয়। তাদের আন্দোলন অধিকারের প্রশ্নে। তাই এসব দাবি সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করা উচিত। আবার এটাও ভুলে গেলে চলবে না, আন্দোলনের নামে নৈরাজ্যের অপসংস্কৃতি নিন্দনীয় ও অপরাধযোগ্য। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতেই পরিস্থিতির সুরাহা হবে বলেই প্রত্যাশা সবার।