অবশেষে সত্য হলো নির্বাচনে বুথফেরত জরিপের তথ্যইÑ দীর্ঘ ১৪ বছর পর যুক্তরাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টিকে (টোরি) হারিয়ে নিরঙ্কুশ জয়ের পরে লেবার পার্টির প্রধান কিয়ের স্টারমার সে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; তিনি গঠন করে ফেলেছেন তার নতুন মন্ত্রিসভাও। টোরি নেতা তথা ব্রিটেনের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের স্থলাভিষিক্ত হলেন তিনি। এর আগে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষানার পরপরই বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক পরাজয় মেনে নিয়ে নতুন নেতাকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ ‘হাউস অফ কমন্স’-এ মোট আসন ৬৫০। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাদুসংখ্যা ৩২৬। লেবার পার্টি নির্বাচনে ৪১২টি আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে তারা। আর প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১টি আসন। লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি পেয়েছে ৭১টি আসনে জয়। দুটি আসনের ফল ঘোষণা এখনও বাকি। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। এবারের নির্বাচনে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৯৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ৩৫টি রাজনৈতিক দল মাত্র ১ জন করে প্রার্থী দেয়। রেকর্ড ভেঙে এবার ৪ হাজার ৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একেকটি আসনে গড়ে ৭ জন করে প্রার্থী। ৩১৭টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৫৯ জন। যুক্তরাজ্যে এবারের সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়নে প্রার্থী হন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয় পেয়েছেন মাত্র ৪ জনই। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই গণনা শুরু হয়। নিয়ম অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দলকে সরকার গঠন ও দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আহ্বান জানান যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লস। গঠিত হয় নতুন সরকার। অন্যদিকে উচ্ছ্বসিত জনগণের উদ্দেশে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার বলেছেন, পরিবর্তন এখন থেকেই শুরু হলো। আমি আনন্দিত।
শুক্রবারই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব নিয়েছেন কিয়ার স্টারমার। এর আগে জয় নিশ্চিত হওয়ার পর সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমাদের রাজনীতিকে জনসেবায় ফিরিয়ে আনতে হবে। দেখাতে হবে, রাজনীতিই কল্যাণকর হতে পারে। দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে জনগণ আমাকে গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। আপনাদের ধন্যবাদ। আপনারা আমাদের দেশ বদলে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, লেবার সরকারের একটাই লক্ষ্য। আর তা হলো, নতুন ধারণার মাধ্যমে দেশের ঐক্য ধরে রাখা। লেবার পার্টি বড় ব্যবধান গড়ে তুলেছে কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এন্থনি আলবানিজ ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ অনেকেই স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগের পাশাপাশি নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বও ছেড়ে দিচ্ছেন ঋষি সুনাক। সরকারি বাসভবন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে শেষ বিদায়ী ভাষণে সুনাক বলেন, ভোটারদের ক্ষোভ, হতাশা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্খা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। দল নতুন নেতা পেয়ে গেলেই পদত্যাগ করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি টোরি (কনজারভেটিভ) নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করব। তবে এখনই নয়। যখন দলের উত্তরসূরি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে তখন। তিনি আরও বলেন, ১৪ বছর সরকারে থাকার পর কনজারভেটিভ পার্টির পুনর্গঠিত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তারা যথেষ্ট পেশাদারিত্ব এবং কৃতিত্বের সঙ্গে বিরোধীদলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে সেটিও কম নয়।
যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে এবার রেকর্ডসংখ্যক ৯জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। আগের রেকর্ডটি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সরকারের ৭ জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছিলেন। রীতি অনুযায়ী এবারও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া টোরি দল পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল হবে। আর দলটির নেতা প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। ৯ জুলাই নতুন পার্লামেন্ট সদস্যদের শপথ গ্রহণ ও স্পিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৭ জুলাই রাজা তৃতীয় চার্লসের উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে নতুন সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে।
বলাই বাহুল্য যে, ব্রিটেনের নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক অতি আগ্রহের বিষয়। প্রথমত, ব্রিটেনে অসংখ্য বাংলাদেশি দীর্ঘদিন থেকে ইমিগ্রান্ট হিসাবে বসবাস করছেন। দেশটির রাজনীতি ও প্রশাসনেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশির অংশগ্রহণ রয়েছে। যেমন, এবারের নির্বাচনেও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক টানা চতুর্থবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। টানা পঞ্চমবারের মতো জিতেছেন রুশনারা আলী, আরও জিতেছেন আপসানা বেগম। উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটেনে ওয়েস্ট মিন্সটার টাইপের গণতন্ত্র চালু রয়েছে। এ পদ্ধতির গণতন্ত্র আমাদের দেশেও চর্চা হচ্ছে। ব্রিটেনে দুটি প্রধান বিরোধী দল লেবার ও কনজারভেটিভই ক্ষমতা ভোগ করে থাকে, অর্থাৎ এই গণতন্ত্রকে বাই-পার্টি ডেমোক্রেসিও বলা যায়। কনজারভেটিভ দল গত টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। লেবার পার্টির মূল নেতা কিয়ার স্টারমার হতে যাচ্ছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটেনের গণতন্ত্রের বড় সৌন্দর্য এই যে, ভোটে কোনো কারচুপি হয় না এবং পরাজিত দল ফলাফল মেনে নেয়। এবারও যেমন সম্পূর্ণ ফলাফল ঘোষণার আগেই ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বিজয়ী লেবার নেতা স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা এখনও রপ্ত করতে পারিনি। ব্রিটেনের এ নির্বাচনে একটি বড় ইস্যু বহুলাংশে ২ দলের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে বলা যায়। আর তা হলো ‘রুয়ান্ডা নীতি’। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ব্রিটেনে রুয়ান্ডার আশ্রয়প্রার্থীদের স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, লেবার পার্টি বলেছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে এই নীতি বাতিল করা হবে। এই নীতির প্রশ্নে ব্রিটেন কার্যত দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
কনজারভেটিভ দলের হেরে যাওয়ার পেছনে আরও কারণ রয়েছে অবশ্য। সেগুলোর একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। অভিবাসী ইস্যুতেও ২ দলের মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য। তৃতীয়ত, কনজারভেটিভ দল টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকায় ভোটাররা শাসনব্যবস্থায় একটা পরিবর্তনও চেয়েছিলেন। তবে ওয়েস্ট মিন্সটার ডেমোক্রেসিতে একটা শুভংকরের ফাঁক রয়েছে বটে। এই গণতন্ত্রে পপুলার ভোটের সমানুপাতিক আসন সংখ্যা নির্ধারিত না-ও হতে পারে। এবার পপুলার ভোটের শতকরা হার হিসাব করলে কনজারভেটিভের পরাজয় অনেক বড় প্রতীয়মান হয়। লেবার পার্টি পপুলার ভোট পেয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ ও কনজারভেটিভ প্রায় ২৪ শতাংশ। আসন সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে বিশাল ব্যবধান। আমরা পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে আগাম অভিনন্দন জানাই। অন্যদিকে বিজিত কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের প্রতি রইল সহমর্মিতা। ব্রিটেনে নতুন যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, সেই সরকার দেশটির অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে সুবিবেচনার পরিচয় দেবে এবং নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
প্রভাত/টুর